১শ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবারের জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যমুনার পানি ১৯৮৮ সালে ১২২ সে.মি. ও ২০১৭ সালে ১৩৪ সে.মি. বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। বুধবার (১৭ জুলাই) বিপদসীমার ১৬১ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত সব রেকর্ডের চেয়ে এবছর বন্যার পানি ২৭ সে.মি. বেশি বলে জানিয়েছেন জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী।
প্রতিদিনই হুহু করে বাড়ছেই পানি। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে বানবাসীর সংখ্যা। বন্যার প্রবল পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশুপাখিসহ সহায় সম্পদ। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে ধান চালসহ খাদ্যসামগ্রী। অনেকেই বসত ভিটার মায়া ছাড়তে না পেরে ঘরের ভিতর মাঁচা করে এবং টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছে। খাদ্য, চিকিৎসা ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবন্দি মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। ত্রাণ পেতে এবং পানিবন্দিত্ব থেকে উদ্ধারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দুর্গত এলাকায় আটকে পড়া মানুষেরা। অনেকেই নৌকা ও ভেলায় পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটছে একটুখানি আশ্রয়ের খোঁজে। অপেক্ষাকৃত উঁচুস্থান ও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনাতে আশ্রয় নিলেও সেখানেও পানি ঢুকে পড়ায় নতুন করে আশ্রয়ের সন্ধানে দিকবিদিক হন্যে হয়ে ছুটছে বানভাসী মানুষেরা।
ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের পূর্ব বলিয়াদহ গ্রামের ৬০ বছর বয়সী আবুল হোসেন জানান, পানির ধাক্কায় ঘরে বছরের মজুদ রাখা বেড়ের ধান, আলু-পেঁয়াজসহ সবকছিু ভাইসা গেছে। হের সাথে ভাইসা গেছে ১০টি মুরগি। ঘরডাও ভাইঙ্গে যাওয়ার অবস্থা। ডরে বউ পোলাপান গরু-ছাগল নিয়ে নাও দিয়ে পারে উঠছি। দুই দিন অইল না খাইয়্যে আছি। কই আশ্রয় নিমু, হেইডাও জানা নাই। রাস্তার ধারে হগলরে নিয়ে বয়ে আছি। আইজ খোলা আসমানেই রাইত কাটাইতে ওইবো।
একই গ্রামের দুলাল উদ্দিন (৪৫), রাশেদ মিয়া (৩০), রশিদ শেখ (৫৫), হবিবর মিয়া, পশ্চিম বলিয়াদহের উরফুল বেগম ও শিংভাঙ্গা গ্রামের নূর ইসলামের কোমর ও গলা সমেত পানি উঠায় রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছে। বলিয়াদহের নৌকাঘাটে নৌকা থেকে নেমে চিনাডুলি গ্রামের ফজলুল কাদের (৪০) স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে নিয়ে টুপলা-টাপলি নিয়ে ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে। সেখানে কথা হয় বানভাসী এ মানুষটির সাথে। তিনি বলেন, অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের বন্যার পানির চাপ বেশি তাই টিকতে পারলাম না। ঘরবাড়ি ফেলে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছি দেওয়ানগঞ্জে বোনের বাড়িতে।
জেলার ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫২টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৬ উপজেলায় ৩ লাখ মানুষ।
ত্রাণ সংকট পুরো বন্যা কবলিত এলাকাজুড়ে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে বানভাসীদের মধ্যে। চিনাডুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে লুৎফর রহমান। তিনি এ প্রতিবেদককে ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করে বলেন, আমগো উনু ইলিফ দিতে কেউ আহে নাই। নোকজন নিয়্যা খাইয়ে না খাইয়ে বহুত কষ্টে আছি।
দুর্গত এলাকায় বরাদ্ধকৃত ত্রাণসামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় যৎ সামান্য। এই নিয়ে মুখ খুলেন ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউনিয়নের চেয়ারমান আব্দুস ছালাম। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্ধ খুবই কম। এত অল্প ত্রাণ দিয়ে ব্যাপক দুর্গত মানুষের চাহিদা মেটানো অসম্ভব। আমার ইউনিয়নের ভাগে কতটুকু পড়েছে? ইউনিয়নের সকল লোকই পানিবন্দি। এত অল্প ত্রাণ দিয়ে পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হিমশিমে পড়ে যাচ্ছি। কপালে জোটে দুর্গতদের গালাগালি আর মেরে দেওয়ার অপবাদ। জেলা প্রশাসনের প্রতি ত্রাণের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
আটকেপড়া বানভাসীদের দ্রুত উদ্ধার তৎপরতার আশ্বাস দেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সংকট নিয়ে তিনি আরো বলেন, প্রতিদিনই ত্রাণের বরাদ্ধের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে এবং অব্যাহত থাকবে।
Leave a Reply