গত বছরের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ সময় রাঙামাটির সঙ্গে অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ প্রায় ১০ দিন বন্ধ ছিল। ছয়টি প্রধান সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। জ্বালানি ও খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। বিদ্যুৎ ছিল না দুই দিন। পাহাড়ধসে ১০টি সরকারি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর পশ্চিম মুসলিমপাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মো. নয়ন। গত বছর পাহাড়ধসে মারা যান তাঁর মা রুবি আক্তার। ধ্বংসস্তূপে অনেক খুঁজেও মায়ের মরদেহটি পাননি তিনি। আশ্রয়কেন্দ্রে কিছুদিন থাকার পর একই স্থানে পুনরায় নতুন ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেন নয়ন।
পাহাড়ধসের এক বছর না যেতেই ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার পুনরায় ঝুঁকি নিয়ে বসবাস শুরু করেছে। এবার বর্ষায়ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ৩১টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে কেবল সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায়িত্ব সেরেছে, তেমন নজরদারিও নেই।
ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে অনুসন্ধান কমিটি যেসব সুপারিশ দিয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নও হয়নি। আসন্ন বর্ষায় প্রাণহানির পাশাপাশি রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, পাহাড়ধসের ১১ মাসেও ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট এবং স্থাপনা পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি।
রাঙামাটি বেতার স্টেশনের পাশে নতুনপাড়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, গতবার যেখানে পাহাড় ধসে পড়েছিল, সেখানে আবার নতুন করে টিন ও বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড়ের পাশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা: ‘পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বসবাস করা নিষেধ’।
সাইনবোর্ডের লাগোয়া গড়ে উঠেছে তিনটি সেমি পাকা ঘর। সেখানে বসবাসকারী এক নারী বলেন, ‘দুই মাস ধরে এখানে আছি। বর্ষার আগে চলে যাব।’ এর পাশে পাহাড়ের চূড়ায় খলিলুর রহমান নামের এক শ্রমিক ঘরের পাশে সবজি চাষ করছিলেন। এই বাড়ির মালিক শামসুল আলম। ঝুঁকিতে বসবাস করছেন কেন, জানতে চাইলে খলিলুর রহমান বলেন, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে।’
নতুনপাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে রূপনগর এলাকা। ওখানে গত বছর এক পরিবারের তিনজন মারা যায়। ওই পরিবারের বাকি সদস্যরা একই এলাকায় ঘর বেঁধে নতুন করে বসবাস শুরু করেছে। একই এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘গরিব বলে অন্য কোথাও জায়গা নেই। তাই পাহাড়ে ঘর বেঁধে বসবাস করি।’
জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, ‘৩১টি পাহাড়ে সাইনবোর্ড দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়েছে। লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে। আশা করি, এবার আর প্রাণহানি ঘটবে না।’
অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, সুপারিশের দৃশ্যমান কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। লোকজন সরানো কিংবা পুনর্বাসন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এসব সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লাগে। সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, সামনের বর্ষায় শুধু রাঙামাটি নয়, অন্যান্য পার্বত্য এলাকা এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে।
বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই গত এপ্রিল থেকে বেশ কয়েক দিন রাঙামাটিতে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। মে মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১৪২ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে ৭ মে ৪৩ মিলিমিটার এবং ৮ মে ৫৪ মিলিমিটার।
রাঙামাটি আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ গাজী হোসেন আহমেদ বলেন, এবার বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। মে মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হলে জুনে অনেক বেশি বৃষ্টি হতে পারে। পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখা হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। এই সড়কের রাঙামাটি অংশে অন্তত ৬০টি স্থানে পাহাড়ধস হয়ে সড়কের ওপর মাটি পড়েছে।
ধসের পর বড় বড় ফাটলের অংশে খুঁটি দিয়ে সড়ক ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। একইভাবে রাঙামাটির মহালছড়ি, ঘাগড়া-কাপ্তাইসহ অন্যান্য সড়কে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত চলে। মহালছড়ি সড়ক, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়, খুঁটি ও লোহার রড দিয়ে সড়কের ধসে পড়া অংশ আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। পাহাড়ধসের পর সাড়ে ১৪ কোটি টাকার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান এখনো করা যায়নি।
বর্ষাকালে পাহাড় ধস নতুন কিছু নয়। এটি রোধ করা আমাদের হাতে নেই। তবে এই বিপজ্জনক জায়গাগুলোর কাছাকাছি অবস্থান না করে এর দ্বারা হওয়া প্রাণহানি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply