ট্যানারি শিল্প মালিকদের কাছে থেকে পাওনা প্রায় শতকোটি টাকা বকেয়া না পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নাটোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। কোরবাণীর ঈদকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠান ধোয়ামুছা করলেও অর্থের যোগান করতে না পারায় এবার মৌসুমে চামড়া কেনা নিয়ে শংকায় পড়েছেন স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা। এতে করে এবার চামড়া ব্যবসায় নজিরবিহীন ধ্বস সহ পাচার হওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা।
নাটোরের চকবৈদ্যনাথ এলাকায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার মোকাম হওয়ায় কেনাবেচার মৌসুম উপলক্ষ্যে নানামুখী প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা। এখানে ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় আড়াইশ জন। নাটোর মোকাম থেকে প্রতি মৌসুমে ৫ থেকে ৭শ কোটি টাকার চামড়া বেচা কেনা হয়। কিন্তু ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে থেকে গত কয়েক মৌসুমের বকেয়া না পাওয়ায় এবার নাটোর চামড়া মোকামে প্রানচাঞ্চল্য নেই। থমকে গেছে কাজ কাম। কাজ না থাকায় চামড়া শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আর ক’দিন পর কোরবানীর ঈদ। অথচ মৌসুমের এই সময়ে টাকার যোগান নেই। এছাড়া চামড়ার দামও নেই। গত মৌসুমে অনেকেই দাম না পেয়ে ছাগল ও ছোট গরুর চামড়া মাটি চাপা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ট্যানারি মালিকদের কাছে থেকে পাওনা টাকা না পেলে এবার নাটোরের চামড়া মোকামে ধ্বস নামার আশংকা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
এদিকে চামড়ার বিদেশী ক্রেতা সংকট সহ চামড়ার দাম না থাকা এবং ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ না করায় নাটোরে এবার চামড়া ব্যবসায় ধ্বসের আশংকা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী সহ জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সদস্যরা। ট্যানারি মালিকদের কাছে থেকে বিগত কয়েক মৌসুমের প্রায় ৫০ কোটি টাকা এবং গত মৌসুমের সমপরিমান টাকাসহ প্রায় শত কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন সহ অর্থ মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
এদিকে গত মঙ্গলবার ঘোষিত মন্ত্রনালয় নির্ধারিত সংগ্রহ দরে রাজধানী ঢাকার বাইরে গরু ও মহিষের চামড়া কেনা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর চামড়ার মোকাম নাটোরের চকবৈদ্যনাথের আড়তদার ও স্থানীয় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে তারা পৃথক যুক্তি দেখিয়েছেন। আড়তদারদের দাবী, নির্ধারিত দামে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করে না। অপরদিকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচা চামড়া সংগ্রহে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে কোন বছরেই সরকার নির্ধারিত দামে গরু, মহিষ ও খাসির চামড়া কেনেন না আড়তদাররা। মঙ্গলবার প্রতি বর্গফুট গরু ও মহিষের কাঁচা চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়ার দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দর ঘোষণার পর এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চকবৈদ্যনাথ মোকামের আড়তদার ও জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মৌসুমী কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা।
গুরুদাসপুর উপজেলার চাচকৈরের মৌসুমি ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান বলেন, ‘কাঁচা চামড়া কিনতে সরকার আড়তদারদের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তাতে কাঁচা চামড়া বিক্রি করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ কোরবানীর পর কোরবানীদাতারা পশুর চামড়ার ভালো দাম পেতে চান যা তাৎক্ষণিকভাবে দর কষাকষির মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। বেশি দামে কিনে কম দামে চামড়া বিক্রি সম্ভব নয়।’
সদর উপজেলার মৌসুমী ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘চামড়া যে দামেই আমরা কিনে থাকি তা আড়তে বিক্রির পূর্ব পর্যন্ত নিজস্ব উদ্যোগে প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে হয়। লবনসহ প্রক্রিয়াজত ব্যয় চামড়ার ক্রয়মূল্যের সাথে যোগ করে আড়তে বিক্রি করতে হয়। এক্ষেত্রে কতদিন নিজস্ব উদ্যোগে চামড়া সংরক্ষণ করতে হবে তা অনিশ্চিত। কাজেই এসব খরচের বিপরীতে প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া সর্বোচ্চ ৪০টাকায় বিক্রি করা মানে নিজের পুঁজি খোয়ানো।’
লালপুরের বিলমাড়িয়া মৌসুমী ব্যবসায়ী আব্বাস আলী বলেন, ‘খাসির চামড়ার যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে তা হতাশাজনক। বিক্রির জন্য খাসির শরীর থেকে চামড়া বিচ্ছিন্নের জন্য যে সতর্কতার প্রয়োজন, অনেক কোরবানীদাতা তা এড়াতে হয়তো চামড়াটি বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে রাখবেন বলে আশংকা করছি। তবুও ব্যবসার খাতিরে চাহিদামতো দাম পরিশোধ করেই চামড়া সংগ্রহ করতে হবে। সংরক্ষণ ব্যয় যোগ করে যে দাম হবে তাতে সরকারী দরে চামড়া বিক্রি করা সম্ভব না।’ অপরদিকে আড়তদাররাও নির্ধারিত দামে চামড়া সংগ্রহের অপারগতা প্রকাশ করেছেন। প্রতিবছর নির্ধারিত দরে চামড়া সংগ্রহে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয় বলে দাবী তাদের।
জেলার চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সাবেক সেক্রেটারি ও বর্তমান কমিটির সহসভাপতি হবিবুল্লাহ বলেন, এমনিতেই অর্থ সংকটের মধ্যে রয়েছেন তারা। এছাড়া চামড়ার দামও কম। এবারেও বেধে দেয়া দরে চামড়া কিনলেও লোকসান গুনতে হবে। তিনি আরও বলেন,গত ৪ /৫ বছর ধরে ঢাকার ট্যানারি মলিকরা তাদের বকেয়া কয়েক কোটি টাকা পরিশোধ করছেন না। যে কারনে তারাও বাহিরের অন্যান্য জেলার চামড়া ব্যবসায়ীদের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছেননা। তাই এবারে চামড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে অসস্তিতে পড়তে হবে।
চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের উপদেষ্টা মুনজুরুল ইসলাম হিরু বলেন,’কোরবানীর কয়েকদিন আগে চামড়ার সংগ্রহ মূল্য কমিয়ে দেয়া হয়। এ মূল্য অনুসরণ করে চামড়া কেনা যায় না। ভালো দাম পেতে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি না করে সংরক্ষণ করলে বাজারে সংকট দেখা দেয়। তখন আড়তদাররা জিম্মি হয়।’
জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সভাপতি শরিফুল ইসলাম শরিফ বলেন, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা টাকা না পাওয়ায় এবার অনেকেই চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিতে পারেননি। গত কয়েক বছরের ৫০ কোটি টাকা সহ গত মৌসুমের প্রায় সমপরিমান টাকা বকেয়া পরিশোধ করেননি ঢাকার ট্যানারি মালিকরা। এতে করে এখানকার প্রায় আড়াইশ ব্যবসায়ী দিশেহারার মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই টাকার অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে রয়েছেন। তবে ট্যানারি মালিকরা তাদের বকেয়া পরিশোধ করবেন বলে আশা করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘চামড়া সংগ্রহের নির্ধারিত মূল্য বাজারে কোন প্রভাব ফেলে না। তাই এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের চিন্তার সুযোগ নেই। ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে হলে নির্ধারিত দর অতিক্রম করেই চামড়া কিনতে হয়। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়ার বড় একটি অংশ সরবরাহ করে থাকে তাই তাদের সিদ্ধান্তই বাজারে প্রতিফলিত হয়।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply