কিছুদিন যাবত দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো তে চলছে ভয়াবহ পুঁজি সংকট। এই সংকট এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে কোন কোন ব্যাংক বড় কোন চেক ভাঙিয়ে দিতে পারছে না, মাঝে মাঝে সেটা ৫ লাখ টাকার চেকের ক্ষেত্রেও হচ্ছে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বড় খাত গুলো তে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে কয়েকটি ব্যাংক এমনকি অনুমোদিত ঋণের টাকা দিতেও তারা হিমশিম খাচ্ছে।এসব খবরে সাধারণ মানুনুষ যারা বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ জমা রেখেছিলেন তারা সেসব অর্থ তুলে নিচ্ছেন। আবার অনেকে তাদের এফডিআর ভেঙে ফেলছেন। এদিকে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের রাখা অর্থও তুলে নিচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে এই অর্থ দিতে গড়িমসি করা হলেও চাপ প্রয়োগের পর ব্যাংক গুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই ভয়াবহ পুঁজিসংকট কেন? ব্যাংকে রাখা সাধারণ আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা গেল কোথায় তাহলে?
দেশের কয়েক জন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশ্লেষকের কাছে উদ্বেগজনক এই প্রশ্ন করা হলে তারা জানান,বেশির ভাগ ব্যাংকে কমবেশি ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা পুঁজি থাকার কথা। এগুলো সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা। ব্যাংক তার নিয়মানুযায়ী এসব টাকা ঋণ দিয়ে ব্যবসা করে থাকে। যথানিয়মে এ পদ্ধতি চালু থাকলে কখনও কোনো ব্যাংকের অর্থ সংকটে পড়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা তো হয়নি। প্রথমদিকে অনিয়ম দুর্নীতি করে যাকে তাকে বাল্ক প্যাকেজে ঋণ দেয়া হয়। ফলে এসব ঋণগ্রহীতা এখন খেলাপি। অথচ এসব গুরুতর অপরাধে কারও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এ কারণে তা পরবর্তীতে আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।
ব্যাংকের মালিক পক্ষ কে দোষারোপ করে তারা আরো বলেন,বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালক তথা মালিক পক্ষ ভাগাভাগি করে একজন আরেকজনের ব্যাংক থেকে মোটা অংকে ঋণ নিয়েছে। কেউ কেউ বেনামেও টাকা সরিয়ে ফেলেছে। এলসি খুলে কোনো পণ্য না এনে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বিশেষ প্রভাবশালীরা। এ রকম অপরাধ করেও কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি। জেলও খাটতে হচ্ছে না। বরং দিব্বি বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ চক্রের হোতারা। এভাবে গত এক দশক থেকে ব্যাংকে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে। এখন যা বিপদসীমায় অতিক্রম করেছে।
দেশের খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদেরা বর্তমানের এই পরিস্থিতি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া কে দোষারোপ করে বলেন,এর ফলে ব্যাংকের মতো দেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর আজ এমন বিপর্যয়পূর্ণ পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, দ্রুত এই অপরাধীদের শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে এ সেক্টর হঠাৎ বালুর বাঁধের মতো ধসে পড়বে। তখন লাখ লাখ আমনতকারী রাস্তায় নেমে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন সব দায় সরকারের কাঁধে এসে ভর করবে।
দেশের বেসরকারি ব্যাংক গুলোতে নজিরবিহীন এই তারল্য সংকট দেখা দেওয়ার কারন হিসেবে বাংলাদেশ সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম ব্যাংক গুলো কেই দায়ী করেছেন।তিনি বলেছেন,প্রাইভেট ব্যাংকের তারল্য সংকটের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম উপেক্ষা করে তারা বেপরোয়াভাবে ঋণ দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত কয়েক বছর ব্যাংকিং খাতে যে লুটপাট হয়েছে, তার খেসারত এখন ভালো ব্যবসায়ীদের দিতে হচ্ছে। একদিকে ব্যাংকে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। অন্যদিকে ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা দিশাহারা।
এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন,যারা সততার সঙ্গে তিলে তিলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তারা আজ ঋণ পাচ্ছেন না। অথচ অস্তিত্বহীন, নাম না জানা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসবই ঋণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে হয়েছে। সরকারের উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি বলেন, ব্যাংক লুটেরাদের শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে।
দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের সূত্র থেকে জানা গেছে,বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংকের কাছে নতুন ঋণ দেয়ার মতো কোনো অর্থ নেই। এমনকি আগের অনুমোদিত ঋণও টাকার অভাবে ছাড় করতে পারছে না। একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, একটি নতুন ব্যাংকের কাছে ৬০ কোটি টাকার অনুমোদিত ঋণ চেয়ে পাওয়া যায়নি।
অপর একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি পুরনো একটি ব্যাংকের কাছে ৬৫ কোটি টাকা অনুমোদিত ঋণ পাননি। বেশির ভাগ ব্যাংকেরই এখন এমন পরিস্থিতি বলে জানান তারা। এছাড়া ফারমার্সসহ কোনো কোনো ব্যাংক এফডিআরের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।
তবে যে সব ব্যাংকগুলো এমন তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে তারা সেই সংকট কাঠিয়ে উঠার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছেন। সংকট পূরণে আমানত সংগ্রহ অভিযানে নেমেছে ব্যাংকগুলো। প্রত্যেকটা ব্যাংকই তাদের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দিয়েছে। আমানত সংগ্রহের সুবিধার্থে বাড়তি সুদের স্কিমও ঘোষণা করছে ব্যাংকগুলো। সরকারি ও বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এমন অভিযানে নেমেছে।
এ বিষয়ে দেশের প্রথম সারির এক বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন,ফারমার্স ব্যাংকে মালিকদের লুটপাটের কারণে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার মাসুল দিয়ে যাচ্ছে পুরো ব্যাংকিং খাত। অবিশ্বাসের জন্ম দেয়া ফারমার্সের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারি সব আমানত তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ আর বেসরকারি ব্যাংককে বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন করে কেউ আমানতও দিতে চাইছে না।
এদিকে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এক কথায় নামতে হয়েছে মার্কেটিং এ। তাদের কে প্রতি মাসে রির্দিষ্ট আমানত সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে সেটা পূরণ করার জন্য তারা বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও লাভবান হচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র থেকে জানা যায়,গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকিং খাতে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। গত কয়েক মাসে ঋণ বিতরণের ফলে তা ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঋণই গেছে সরকারি ব্যাংক থেকে। গত বছর ব্যাংকগুলো ৮৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। কিন্তু ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৩১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের তুলনায় ৪৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। এতে অলস অর্থ চলে গেছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ফারমার্স ব্যাংক তাদের আমানতকারী অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে যে কারনে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর ই আস্থা উঠে গেছে সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে অর্থ রাখতে আর কোন ভরসা পাচ্ছে না।
Leave a Reply