দিনের শুরুটা ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। সপ্তাহান্তের ছুটির দিনের আগে ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দারা নিচ্ছিলেন ছুটি কাটানোর প্রস্তুতি। কিন্তু দিনের শেষটা হলো রক্তের সোঁদা গন্ধে। শহরে এখন ভয়ের রাজত্ব। রাতটা নিশ্চয়ই নির্ঘুম কাটবে ক্রাইস্টচার্চের, সঙ্গী থাকবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
শান্তির সূচকে বিশ্বজুড়ে সুনাম নিউজিল্যান্ডের। ২০১৮ সালে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে দেশটি। এমন একটি দেশেই শুক্রবার দুপুরে এক মসজিদে হলো নারকীয় সন্ত্রাসী হামলা। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪৯, আহত ৪৮। এর মধ্যে তিনজন বাংলাদেশিও রয়েছেন। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন অনেকে।
অকস্মাৎ এমন হামলার ঘটনায় নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আরও বেশি হতবুদ্ধি অবস্থা ক্রাইস্টচার্চের মানুষের।
এদিকে নিউজিল্যান্ডে স্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী যুবকের সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে দেশটির অস্ত্র আইন আরো কঠোর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে তিনি জানান, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এর বিস্তারিত ঘোষণা দেওয়া হবে। এর মধ্যেই হামলার পর গতকাল আল নুর মসজিদে কান্নায় ভেসে নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিরা। দেশজুড়েই গতকালও আদিবাসী, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকজন শোক পালন অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যই গতকাল হামলাকারী তার আইনজীবীকে বরখাস্ত করেছে। এ ছাড়া হামলাকারী ব্রেন্টন টারেন্টের অস্ট্রেলিয়ার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ।
গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেন, তাঁর কোয়ালিশন সরকার ওই সব অস্ত্রের সহজলভ্যতা কমিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, যে অস্ত্র মসজিদে হামলায় ব্যবহার করেছিল হামলাকারী ব্রেন্টন টারেন্ট। তিনি বলেন, ‘আমরা মন্ত্রিসভায় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ এ সময় তাঁর পাশে ছিলেন কোয়ালিশন সরকারের শরিক দলের নেতা ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন পিটারস।
এর আগে অস্ত্র আইনে পরিবর্তন আনার বিরোধী ছিলেন পিটারস। তবে গতকাল তিনি জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরের ঘটনার পর বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের পৃথিবী চিরতরে বদলে গেছে। সুতরাং আমাদের আইনও বদলে যাবে।’
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, দেশজুড়ে শোকাবহ পরিবেশ এখনো বিরাজ করছে। দেশটির সব সম্প্রদায়ের লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহতদের স্মরণে কর্মসূচি পালন করছেন, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। এর মধ্য কয়েক ডজন শিক্ষার্থী আল নুর মসজিদের বাইরে ঐতিহ্যবাহী মৌরি নাচের মাধ্যমে ‘হাকা’ (বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান) অনুষ্ঠান পালন করে। গতকাল অকল্যান্ডে ওরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘কিয়া কাহা’ (শক্ত থাকুন) বলে সম্মিলিত কণ্ঠে গাই গেয়ে এ অনুষ্ঠান পালন করেন।
এ ছাড়া শোকাবহ পরিস্থিতির কারণে নিউজিল্যান্ডের অন্যতম বৃহত্তম অস্ত্র বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘গান সিটির’ বার্ষিক অস্ত্র প্রদর্শনী স্থগিত ঘোষণা করেছে। গতকাল থেকে এ প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল গতকাল আল নুর মসজিদে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার ও তাদের বন্ধুরা মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। এ সময় তাদের সম্মিলিত করুণ কান্নার সূর পার্শ্ববর্তী পার্ক থেকেও শোনা যায়।
মসজিদে কান্নার প্রসঙ্গে নামাজ পড়তে আসা সাইয়্যেদ রাজা নামের এক ব্যক্তি এএফপিকে বলেন, ‘এটা আমাদের সন্ধ্যাকালীন নামাজের সময় ঘটেছে। আপনি যেখানেই থাকুন, আপনি প্রার্থনা করতে পারেন।’ গত শুক্রবারের হামলায় মারা যাওয়া তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের দাফনের জন্য তিনি অকল্যান্ড থেকে এখানে আসেন।
এর মধ্যেই হামলাকারী সন্ত্রাসী বেন্টন টারেন্ট গতকাল তাঁর রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী রিচার্ড পিটারসকে বরখাস্ত করেছে। এ আইনজীবী এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, হামলাকারী বলেছে সে নিজেই আদালতে তার বক্তব্য তুলে ধরবে।
অন্যদিকে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে গুলি করে ৫০ মুসল্লি হত্যাকারী অস্ট্রেলীয় নাগরিক ব্রেন্টন টারান্টের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা দুই বাড়িতে গতকাল তল্লাশি চালিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ। এক বিবৃতিতে পুলিশ জানায়, নিউ সাউথ ওয়েলস শহরের স্যান্ডি বিচ ও লরেন্সের দুই বাড়িতে বেড়ে উঠেছিল অভিযুক্ত শ্যুটার টারেন্ট। এ অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য, সেখানে পাওয়া কিছু জিনিসপত্র দিয়ে নিউজিল্যান্ড পুলিশকে তদন্ত কাজে সহযোগিতা করা। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডুটন গতকাল বলেছেন, গত তিন বছরে টারেন্ট মাত্র তিন দিন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করেছি।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ জয় রহমান
Leave a Reply