কোরবানির পশুর উচ্ছিষ্ট বর্জ্য হলো পশুর হাড়, শিং, অন্ডকোষ, নাড়িভুড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলী ও চর্বি। সাধারণত এসব ফেলেই দেয়া হয়। কিন্তু এ সকল উচ্ছিষ্ট সামগ্রী বিক্রি করেই বছরে কোটি টাকা আয় করছেন কিছু মানুষ। পশুর উচ্ছিষ্ট বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া এ সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির জন্য রয়েছে বাজারও। রাজধানীর হাজারীবাগ, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এবং হাসনাবাদে রয়েছে এ সবের বাজার।
হাজারীবাগ ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর গুলাশান, মহাখালী, পুরান ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া পশুর বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন কসাই, পথশিশু, পরিচ্ছন্নকর্মী ও ফেরিওয়ালারা। তারা এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে হাড্ডিপট্টির ভাঙারি দোকানে নিয়ে বিক্রি করছে। ভেজা হাড়, মাথা, দাঁত বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি, আর শুকনো হাড়ের কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা। কেজি হিসেবে পশুর অন্ডকোষ ও লিঙ্গ ২৫ থেকে ৪০ টাকা, শিং ৬০ থেকে ৮০ টাকা, চর্বি ৩০ থেকে ৬০ টাকা, রক্ত ৮ থেকে ১৫ টাকা।
ব্যবসায়ীরা জানান, হাড় ওষুধের ক্যাপসুলের কাভার, সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। সারা বছর ধরে বিভিন্ন বাজার থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হলেও, তা জমে ওঠে কুরবানির ঈদে। জানা গেছে, কারখানাগুলোয় প্রথমে হাড় শুকিয়ে গুঁড়ো করা হয়। হাড়ের গুঁড়ো ক্যাপসুলের আবরণ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। পাশাপাশি হাড় ও হাড়ের গুঁড়ো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। গরু, মহিষ ও ছাগলের শিং ভারতে রপ্তানি হয়। শিং দিয়ে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি করা হয়। সাবান তৈরিতে ব্যবহার হয় চর্বি। রক্ত শুকিয়ে পোল্ট্রি, পাখির খাবার তৈরি হয়।
এছাড়া মাথার হাড় মেলামাইন তৈরিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। পশুর শিং দিয়ে তৈরি হয় চিরুনি, বোতাম, এক্স-রে ফিল্ম, ক্যামেরার ফিল্ম, ঘর সাজানোর শো-পিছ। পুরান ঢাকার হাজারীবাগের হাড্ডিপট্টিতে পশুর এসব বর্জ্য কেনার জন্য ৩০ থেকে ৪০টি ভাঙ্গারির দোকান রয়েছে। সে দোকানে গরু-মহিষের হাড় ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচাকেনা চলে।
স্থানীয় হাজারীবাগের মেসার্স আরিফ ব্রাদার্স নামে আড়তের মালিক শুকুর মিয়া বলেন, হাড় ওষুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হবে। প্রতি টন ২৩ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। নিজেরই হাড় গুঁড়ো করার মেশিন আছে জানিয়ে শুকুর বলেন, দেশে প্রায় ১৫০টি ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ক্যাপসুল তৈরি করে। বেশ কিছু কোম্পানি গুঁড়া করা হাড় থেকে ক্যাপসুলের সেল তৈরি করে। এতে প্রতি মাসে টনের পর টন পশুর হাড় প্রয়োজন হয়। জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার পশুর অন্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয়। চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েক জেলার ব্যবসায়ীরা অন্ডকোষ কিনে বিদেশে পাঠান।
আরেক ব্যবসায়ী রহিম মিয়া বলেন, কুরবানির পর তিনি হাড়, অন্ডকোষ, রগ, শিং কিনেছেন ২ টন। এ সপ্তাহে এগুলো ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাবেন। তারা আবার এটা চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করবে। গরুর অন্ডকোষ সংগ্রহের পর এগুলো রোদে শুকানো, কিংবা হিমাগারে রাখতে হয়। সারা দেশ থেকেই বিক্রির জন্য এগুলো ঢাকায় আসে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরির কাজে হাড় ব্যবহার করা হয়। এছাড়া রগ আর অন্ডকাষ জাপান, কোরিয়ায় রপ্তানি করা হয়। প্রতি মণ গরু ও মহিষের অন্ডকোষ (শুকানো) ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রাজশাহীসহ বড় শহরগুলো থেকে এ সব বর্জ্য কেনার পর প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রতিটি অন্ডকোষের রপ্তানিমূল্য ৪ থেকে ৬ ডলার।
সারাদেশে পশুর বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ৩০ থেকে ৩৫টির মতো কারখানা রয়েছে, যেখানে হাড় গুঁড়ো করা হয়। রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ছাড়াও হাড় ভাঙার কারখানা আছে যাত্রাবাড়ী ও কোনাপাড়া মৃধাবাড়ী এলাকায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে চারটি হাড়ের কারখানা। খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকায় রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ৩টি হাড় কারখানা প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার হাড় বিদেশে রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। ৩টি কারখানাই বর্তমানে লাভজনকভাবে চলছে। এগুলো গত অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার পশুর হাড় রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও এখন হাড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।
এদিকে চামড়াশিল্প ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে গরু প্রায় ৪০ লাখ। ছাগল, ভেড়া ও মহিষ প্রায় ৭০ লাখ। গরু প্রতি গড়ে ১৫ কেজি করে হাড় হলে ৪০ লাখ গরু থেকে ৬০ কোটি কেজি হাড় হবার কথা। যা ৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হলে চারশ’ আশি কোটি টাকা হয়। যদিও সব গরুর হাড়ই যে বিক্রি করা হচ্ছে বা যাচ্ছে তা নয়। তবে এই সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবকে চারভাগের একভাগে নিয়ে আসলেও কোটির বেশি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি মাঝারি আকারের গরু থেকে ১৫/২০ কেজি হাড় হয়। কোরবানিসহ সারা বছর জবাই করা গরুর হাড়ের মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া শিং, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাড় রপ্তানিতে ব্যবসায়ীরা পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বছরে শতকোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। চীন ও থাইল্যান্ডে গরুর হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পশুর রক্ত, গোবর, নাড়িভুঁড়ি, হাড় ও অন্যান্য উচ্ছিষ্টাংশ সার, বোতাম, চিরুনি, মৎস্যখাদ্য, পশুখাদ্যসহ বেশ কিছু শিল্পে ব্যবহার করা যায়।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, পশুর বর্জ্য-হাড়, শিং, চামড়া, ভুড়ি, অন্ডকোষ, মূত্রথলি, চর্বি, রক্ত সবই রপ্তানিযোগ্য। অধিকাংশই রপ্তানি হয় চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply