যে কোনো বিজনেসের জন্য প্লেনিং বা পরিকল্পনা হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। একটি ভালো পরিকল্পনা ব্যতীত বিজনেসের যাত্রা শুরু করা হচ্ছে অনেকটা অন্ধকারে ঢিল মারার মত। কো-ওয়ার্কিং হচ্ছে এমন একটি নতুন ব্যবসা যেখানে একই ছাদের নিচে অনেক জন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এই ব্যবসাটি মূলত অফিস শেয়ারিং থেকে নতুন এক বিজনেসের মডেলে রূপান্তরিত হয়ছে। অনেকে এটাকে একটা নতুন ধরনের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও বলে থাকেন। আবার অনেকের মনে করেন এটা স্বতন্ত্র এক ধরনের বিজনেস ।
২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই সময়কালে বিশ্বের বিভিন্ন বড় শহর গুলোতে এই ব্যবসাটি একটি স্বতন্ত্র অবস্থান করে নেয়। যদিও এর আগে এই বিজনেস এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে এসময় কালকেই গ্রোথ স্টেজ বলা যায়। এই বিজনেসটি নিউইয়র্কে থেকে উৎপত্তি লাভ করলেও পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্রান্সেস্কো, সিলিকন ভ্যালী সহ আমেরিকার অন্যান্য শহরে বিস্তার লাভ করে। একই সময়ে এই বিজনেসটি চীন, জার্মানি, সিংগাপুর, ফিলিপাইন, হংকং সাউথ কোরিয়া সহ বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স এবং আইটি বেইজ স্টার্ট আপ গুলো ক্রমবর্ধমান বিকাশের কারণে নতুন এই বিজনেসটি দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে।
আমাদের দেশে এই বিজনেস সবেমাত্র কয়েক বছর ধরে শুরু হলো।বেশ কয়েক জন দেশি উদ্যোক্তার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারী ও এই বিজনেস টি করার চেষ্টা করছেন। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক উদ্যোক্তাদের টার্গেট করেই এই বিজনেসটি পরিচালিত হচ্ছে।
এই ব্যবসাটি করার জন্য বেসিক কিছু বিষয় ধারণা থাকা প্রয়োজন।ধারাবাহিক ভাবে তা আলোচনা করা হলো :
সার্ভে ও রিচার্জ করুন : কোন বিজনেস করার পূর্বে সেই বিজনেস এর উপর সার্ভে ও রিচার্জ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনেক সময় কেউ কোন নতুন আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে বিজনেস আরম্ভ করলে অনেকেই তা না বুঝে একই বিজনেস করতে ঝুঁকে পড়েন। যার ফলে ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের মধ্যে কোন ভারসাম্য থাকে না। এই বিজনেসে অবশ্যই ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই বাড়াতে হবে।
সঠিক স্থান নির্ধারণ করুন : ঢাকা শহরের বড় সমস্যা হচ্ছে যানজট। এই যানজট মোকাবেলা করে একজন উদ্যোক্তা বা ফ্রিল্যান্সার আপনার এখানে এসে কাজ করবে, কাজেই এমন একটা জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেখানে সহজে যোগাযোগ করা যায়। বিশেষ করে মেইন রাস্তার কাছে হলে ভালো হয়। পাশাপাশি সেফটি সিকিউরিটি ও পার্কিংয়ের সুবিধা আছে কিনা এ বিযয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
যেহেতু এটা একটা নতুন ধরনের বিজনেস তাই এই বিজনেসটা করার জন্য কম টাকার মধ্যে ভাড়া নেওয়ার বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে বর্ধিত করতে পারেন এরকম একটা জায়গা নির্বাচন করা প্রয়োজন । ঢাকা শহরের কিছু সুপার শপ আছে যে গুলো হ্যান্ডওভার দেওয়ার পর বছরখানেক সময় প্রয়োজন হয় পরিচিতি লাভ করতে বা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে। এছাড়া গত কয়েক বছর যাবৎ ছোট এবং মাঝারি ব্যবসা গুলো খুব মন্থর গতিতে অগ্রসর হচ্ছে যে কারণে অনেক কমার্শিয়াল স্পেস ভাড়া হচ্ছে না। এই সুযোগটি কো-ওয়ার্কিং বিজনেসে কাজে লাগাতে পারেন। যেখানে এডভান্স ও ভাড়া তুলনামূলক কম হয়ে থাকে।
সার্ভিস ডিজাইন এবং সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করুন : একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী মূলত তার খরচ কমানো এবং কাজের পরিবেশের জন্যই কো-ওয়ার্কিং স্পেস ব্যবহার করে থাকে। কাজেই সার্ভিস চার্জটি রিজনাবল হতে হবে এবং উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধার উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সার্ভিস ডিজাইন কয়েকভাবে রাখা দরকার। প্রয়োজনে কাস্টমাইজ করতে হবে।
যে সকল সুবিধা রাখতে হবে : ফটোকপি, প্রিন্টিং, লেমিনেটিং, কনফারেন্স রুম, মিটিং রুম, লকার ইত্যাদি ব্যবহার করার সুবিধাগুলো রাখতে হবে। প্রয়োজনে এই সব সার্ভিসের জন্য বর্ধিত চার্জ আদায় করুন। কো-ওয়ার্কিং বিজনেসের জন্য এগুলো হচ্ছে বেসিক সাপোর্ট।
অন্যান্য সুবিধা : এছাড়া কফি শপ,জিম, লাইভ মিউজিক এবং স্মোকিং জোন ইত্যাদি বিভিন্ন ফেসিলিটিস রাখতে পারলে আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করবে। এ ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখাটা বেশ ব্যয়বহুল। তাই এমন একটি জায়গায় কো-ওয়ার্কিং ব্যবসাটি আরম্ভ করুন যার আশে পাশে কফি শপ, লাইভ মিউজিক ও স্মোকিং জোন এর সুবিধা আছে।আপনি সুবিধা না দিতে পারলেও আপনার কাস্টমাররা যাতে এই সুবিধাগুলো নিতে পারে সেই বিযয়ে লক্ষ রাখুন।
একজন উদ্যোক্তা বা ফ্রিল্যান্সার কাজ করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।শুধু মাত্র অফিসের সাপোর্ট দিয়ে তার বিজনেস প্রতিষ্ঠা করা যায় না।নতুনদের জন্য বিশেষ করে লিগ্যাল সাপোর্ট, বেন্ডিং মার্কেটিং ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় এর উপর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলে বা সঠিক গাইড লাইন দিতে পারলে তরুণ উদ্যোক্তা এখানে কাজ করতে অধিক উৎসাহ পাবে।
সঠিক টিম নির্বাচন করা : এই ব্যবসার জন্য আপনাকে অবশ্যই একটা ভালো টিম থাকতে হবে। বিশেষ করে এডমিন, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট রেভিনিউ এই বিষয়গুলোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।প্রয়োজনে আপনি নিজে টিম লিডার হয়ে কাজ করুন।
অবশ্যই যেহেতু ব্যবসা টি নতুন, মার্কেটে টিকে থাকার জন্য মানসিক এবং আর্থিক অবস্থান তৈরি করে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করুন। তবে এই বিজনেসটি যতদিন যাবে তত নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পাবে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে এটা কোন ওয়েবসাইট বা অ্যাপস ভিত্তিক ব্যবসা না। এটা নেটওয়ার্ক ও উদ্যোক্তাদের প্রফেশনাল পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। স্টার্টআপ কালচারের সাথে কো-ওয়ার্কিং একটি সাপোর্টিং উইনং হিসাবে কাজ করবে।
মাকেটিং কিভাবে করবেন : যেহেতু কনসেপ্টটি নতুন তাই সময়োপযোগী মার্কেটিং প্রয়োজন। এখানে আপনার টার্গেট কাস্টমার হচ্ছে মূলত ২০ থেকে ৩০ বছরের ছেলে মেয়েরা, তবে উদ্যোক্তা হওয়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নাই। কেউ ৬০ বছর বয়সে ও উদ্যোক্তা হতে পারে। কাজই আপনার কে সিনিয়র সিটিজেনকে ও আপনার টার্গেট কাস্টমার হিসাবে চিন্তা করতে পারেন। সব ধরনের ডিজিটাল মার্কেটিং এর পাশাপাশি পত্রিকায় এ বিষয়ে অনেক ফিচার লেখা এবং পি আর এজেন্সির মাধ্যমে নিউজ পাবলিশ করে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলুন।
একজন উদ্যোক্তা কে স্বতন্ত্রভাবে একটি অফিস ভাড়া নেওয়া অথবা বাসায় বসে কাজ করার কি কি অসুবিধা হয় এবং কো-ওয়াকিং প্লেইসে কি কি সুবিধা আছে এ বিষয়টা বিভিন্ন উপায়ে তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। কো-ওয়ারর্কিং বিজনেস মূলত নেটওয়ার্কিং, গুড ওয়েল এবং উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সুবিধার উপর ভিত্তি করে ডেভেলপ করতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে মনে হতে পারে এই বিজনেসে অনেক বড় বিনিয়োগ দরকার এবং যথেষ্ট পরিশ্রম মেধা ও পরিকল্পনার থাকতে হবে। কিন্তু আপনি চাইলে খুব অল্প বিনিয়োগ করেও আরম্ভ করতে পারেন। আপনার নিজের অফিস শেয়ার করে এবং একটি ফেসবুক পেইজ এর মাধ্যমে টার্গেট কাস্টমার এর মাঝে ডিমান্ড ক্রিয়েট করে আপনি এই বিজনেস আরম্ভ করতে পারেন।ব্যবসার ডিমান্ড বাড়ার সাথে সাথে আপনার অফিস বর্ধিতকরণ এর ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে এমন একটি জায়গায় অফিস নিতে হবে যেখানে ভবিষ্যতে বড় স্পেস নিয়ে ব্যবসাটি সম্প্রসারণ করার সুবিধা আছে।
আপনি যদি কোন কো-ওয়ার্কিং প্লেসে ভাড়া নেবার কথা চিন্তা করে থাকেন তাহলে আপনি নিজেও আপনার নিজস্ব বিজনেস এর পাশাপাশি নতুন ও সময় উপযোগি এই ব্যবসাটি করার চেষ্টা করতে পারেন। আপনার মতো আরও দুই একজন উদ্যোক্তাদের নিয়ে পার্টনারশিপে ও এই বিজনেস করা সম্ভব। অফিস শেয়ারিংয়ের মধ্য দিয়েই এই বিজনেসের মডেলটি গড়ে উঠেছে। কাজেই আপনিও একই ভাবে অল্প ইনভেস্টে আরম্ভ করতে পারেন।
বিশ্বব্যাপী এক একটি বিজনেস একটা নির্দিষ্ট সময়কালে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি এবং বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তা গড়তে সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ও আসছে। কো-ওয়ার্কিং বিজনেসের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা। কাজেই এখনই সময় আধুনিক এই বিজনেসে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সময় উপযোগী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
লেখক: অনিক রায়হান
তরুণ উদ্যোক্তা,রিয়েল এস্টেট কনসালটেন্ট
Email: rayhan8484@gmail.com
Leave a Reply