দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে ভয়ংকর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জ ও পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
ডিটারজেন্ট পাউডার, সোডা, সয়াবিন তেল, লবণ, চিনি, স্যালাইন, নিম্নমানের গুঁড়া দুধসহ মারাত্মক সব কেমিক্যাল মিশিয়ে একটি চক্র ভেজাল দুধ তৈরি করছে। তারপর সেই দুধ দেশের বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের কোম্পানির মাধ্যমে প্যাকেটজাত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। শুধু তাই নয়, বিষাক্ত এ নকল দুধের ক্রিম থেকে তৈরি হচ্ছে খাঁটি গাওয়া ঘি। এসব দুধের ছানা থেকে তৈরি হচ্ছে রসনাবিলাস বাহারি সব মিষ্টান্ন। এই দুধ ও দুগ্ধজাত মিষ্টি, ঘিসহ মিষ্টান্ন খেয়ে মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
প্রকাশ্য এই ভয়াবহ অবৈধ কর্মকাণ্ড চলে আসলেও অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন রয়েছে নির্বিকার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর এমন কর্মকাণ্ড হচ্ছে দেশের দুগ্ধ ভাণ্ডারখ্যাত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর,পাবনার ফরিদপুর, ভাংগুড়া, সাঁথিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায়।
প্রতিবেদক গত ৪ মাস ধরে এসব এলাকায় কারবারিদের সঙ্গে কথা বলে অনুসন্ধান চালিয়ে এই ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের তথ্যপ্রমাণ পান। সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের গবাদিপশুসমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার ফরিদপুর, ডেমরা, ভাংগুড়া, সাঁথিয়া উপজেলায় এখন ভয়ংকর নকল দুধের রমরমা ব্যবসা চলছে। এই ভেজাল দুধ প্রক্রিয়াজাতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কারখানা। এসব কারখানায় চলছে নকল দুধের নানা কারবার। এই ভেজাল দুধে নানা প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে ঘি,ছানা,প্যাকেটজাত দুধ।
দেশের বাজারে দুগ্ধজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এটি এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে। গবাদিপশু পালন ও তা থেকে দুগ্ধ উৎপাদন করে বিক্রি করে অনেক খামারি এবং বেকার যুবক-যুবতী স্বাবলম্বী হলেও হঠাৎ করে ভেজাল দুধ উৎপাদনকারী একটি সিন্ডিকেটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে এই শিল্প। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাঁটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের এই সিন্ডিকেটের কারণে এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
দুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একাধিক ফড়িয়া ব্যবসায়ী এবং খামারিদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকাশ্য দিবালোকে তৈরি হচ্ছে ভেজাল দুধ। ফড়িয়া দুধ ব্যবসায়ী এবং কিছু দুধ থেকে ঘি ক্রিম, ছানা, দই-মিষ্টি উৎপাদনকারী কারখানার মালিক এসব অপকর্ম করছে। তথ্যের সূত্র ধরে সরেজমিন যান এই প্রতিবেদক।
উল্লাপাড়া উপজেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরের গ্রাম কালিয়াকৈড়। এই গ্রামটি গবাদিপশুসমৃদ্ধ। পশু পালন এবং তা থেকে দুগ্ধ উৎপাদন করে গ্রামের সিংহভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এই খামারিদের কাছ থেকে দুগ্ধ সংগ্রহের জন্য কাজ করছে প্রায় ১৫-১৬ জন ফড়িয়া ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভেজাল দুধ তৈরির অভিযোগ পাওয়া যায়। সেই তথ্যের সূত্র ধরে বুধবার সকালে কালিয়াকৈড় গ্রামে ভেজাল দুধ তৈরির প্রক্রিয়ার দেখা মেলে।
তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হবে না নিশ্চিত করে এক ফড়িয়ার বাড়িতে কাকডাকা ভোরে হাজির হয় প্রতিবেদক। তিনি দেখালেন, ভেজাল দুধ তৈরির পুরো প্রক্রিয়া। এই ফড়িয়া ব্যবসায়ী এমন ভেজাল দুধ তৈরিতে যা ব্যবহার করলেন তা দেখে চক্ষু ছানাবড়া। তিনি প্রথমে একটি বিলিন্ডার মেশিনে হাফ কেজি খাঁটি দুধ নিলেন। তার সঙ্গে পরিমাণ মতো ডিটারজেন্ট পাউডার, সোডা, হাফ কেজি সয়াবিন তেল, চিনি, স্যালাইন, লবণ, গুঁড়া দুধসহ বিভিন্ন মাত্রায় কেমিক্যাল মিশিয়ে ১৫ মিনিট বিলিন্ডার মেশিনে বিলিন্ডার করলেন। বিলিন্ডার মেশিনে দুধের সঙ্গে সব কেমিক্যাল পদার্থগুলো ভালোভাবে মেশানো হয়। এভাবে আরও তিন দফায় তিনি এই কাজ করলেন। এরপর সব দুধ একটি পাতিলে ঢেলে তার সঙ্গে এক মণ সাদা পানি মিশিয়ে তৈরি করলেন ভেজাল দুধ। এভাবে এক মণ দুধ তৈরি করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ২০০-২৫০ টাকা। আর তা বিক্রি করা হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা। যা তার উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি লাভ।
তিন মণ ভালো দুধের সঙ্গে ১ মণ ভেজাল দুধ মিশিয়ে পুরোটাই ভালো দুধ দেখিয়ে সে সরবরাহ করছে নামিদামি বিভিন্ন দুধ ক্রয়কারী কোম্পানি, ঘি ক্রিম এবং ছানা তৈরি কারখানার কাছে। এভাবে তিনি প্রতিদিন প্রায় দুই মণ ভেজাল দুধ তৈরি করে ছয় মণ খাঁটি দুধের সঙ্গে বিক্রি করেন। এদিকে এই ফড়িয়া ব্যবসায়ী আরেকজন ভেজাল দুধ তৈরিকারক ফড়িয়া ব্যবসায়ীর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেই বাড়িতে যেতেই বাইরে থেকে বিলিন্ডার মেশিনের শব্দ পাওয়া গেল। অপরিচিত লোক দেখে তিনি ভয়ে ভড়কে গেলেন। সঙ্গে থাকা ফড়িয়ার কথায় আশ্বস্ত হয়ে তার ঘরে ঢুকে দেখা গেল তিনি দুটি বিলিন্ডার মেশিনের মাধ্যমে একই প্রক্রিয়ায় দুধ তৈরি করছেন।
এই দুই ব্যবসায়ী জানালেন, তাদের মতো এ গ্রামের সব ফড়িয়া ব্যবসায়ীই একই কর্ম করে। তাদের পাশের গ্রাম সুজা, চাচকিয়াসহ সব গ্রামের দুধ ব্যবসায়ীরাই এ কাজ করছে। আর তা নাকি সবারই জানা।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply