একটি ফাঁস হয়ে পড়া কথোপকথনে ফেঁসে গেলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব) মিজানুর রহমান মিজান।
লন্ডনে বসে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেকের নির্দেশে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বড় ধরনের নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড-, বিএনপির কর্মীদের আওয়ামী লীগের কর্মী সাজিয়ে জাল ভোট প্রদান, অপ-প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচন বানচাল, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ছক কষেছিল বিএনপি।
এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে মিজানকে। গাজীপুর নির্বাচনে নাশকতার ষড়যন্ত্র করার বিষয়ে তার টেলিফোনে কথোপকথন সংক্রান্ত দুটি অডিও ক্লিপ জব্দ করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা।
বিএনপির আরও বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে মেজর (অব) মিজান। রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মেজর (অব) মিজানকে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে বানচাল ও বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রে জড়িত বিএনপির আরও অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ফেঁসে যেতে পারেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, সোমবার দিবাগত রাত প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে গুলশান-১ নম্বরের ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব) মিজানকে। এর আগে রাত ১টা থেকে তার বাসা সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্ম পোশাকে থাকা পুলিশ ঘিরে রাখে। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দিক বলেছেন, থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। ডিবি পুলিশের একটি অভিযান ছিল। তারা গ্রেফতার করতে পারে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেছেন, গাজীপুরে নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতার ষড়যন্ত্রে তাকে (মিজান) গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইসিটি এ্যাক্টে মামলা হচ্ছে। এ ছাড়াও মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
এর আগে একটি ইউটিউব চ্যানেলে মেজর (অব) মিজানের কথোপকথনের একটি অডিও প্রকাশ করা করেছে কন্সপিরেসি লিক নামক একটি প্রতিষ্ঠান। ওই অডিও ক্লিপটি যে মেজর (অব) মিজানের তা নিশ্চিত করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
সে সূত্র ধরেই গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালায়। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অডিও-এর ভাইরাল হয়েছে। ফোনের অন্য প্রাপ্তে যে ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তার নাম সাইফুল ইসলাম। তিনি আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়নের যুবদলের স্থানীয় নেতা। কথোপকথনের অডিও করা হয়েছে দুইটি।
অডিও কথোপকথনটি হুবহু তুলে দেয়া হলো।
অডিও- এক :
-স্লামালাইকুম।
মেজর (অব) মিজানুর রহমান: ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো?
-আছি মোটামুটি।
মেজর মিজান : আচ্ছা, তোমাদের এখান থেকে কাশিমপুর ইউনিয়নের যে ভোটকেন্দ্র, কতটুক দূর?
– মানে আমাদের পাশেরডা হইলো এক নম্বর ওয়ার্ড।
মেজর মিজান : হ্যাঁ, এটা তোমাদের এখান থেকে কতটুকু দূর, ভোট কেন্দ্রটা ?
– এই ১৮ কিলো হইবো। এক নম্বর ওয়ার্ডে কেন্দ্র হইলো তিনটা।
মেজর মিজান: আচ্ছা, ওখানে তোমাদের ক্লোজ বন্ধু-বান্ধব আছে?
– হ্যাঁ।
মেজর মিজান: আচ্ছা, এখানে আমাকে একটা ছেলে, পারলে দুটিই ছেলে দাও। যারা আওয়ামী লীগের ব্যাচ লাগিয়ে ঘুরতে পারবে। এ রকম কিছু ছেলে ম্যানেজ করতে পারবা?
-হ্যাঁ, এ রকম আছে।
মেজর মিজান: আছে? প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের লোক নাও, যারা মনে মনে বিএনপি। আছে এমন?
– জ্বি আছে।
মেজর মিজান: তিনটা ছেলে সিলেক্ট করো। তিনটা ছেলে সিলেক্ট করো, হ্যাঁ? ওরা নৌকার ব্যানার নিয়ে ঘুরবে। ওদের আমি বলে দেবো। ওদের টাকা-পয়সা দিয়ে দেবোনে। আমি ইলেকশনের দিন যন্ত্রপাতি দিয়ে দেবোনে। তুমি ছেলে তিনটা আগে সিলেক্ট করো। তিন সেন্টারের জন্য তিনজন। ওকে?
-ওকে।
মেজর মিজান: ওকে। শোনও, শোনও শোনও শোনও। যে পোলিং সেন্টারটা, মানে যে কোন তিনটা পোলিং সেন্টারের যে কোন একটা সেন্টারের পাশে আমাদের লোকের বাড়ি থাকতে হবে। যে বাড়ির জানালার পাশে বসে… দোতলা কিংবা তিনতলা বাড়ি থাকলে ভাল হয়।
– আমি রেডি করবোনে।
মেজর মিজান : হ হ রেডি করো, আর তিনটা ছেলেকে রাখবা, অন্য কাজে। ওই তিনটা ছেলে আওয়ামী লীগের ব্যাচ লাগিয়ে ঘুরবে।
– আচ্ছা, ঠিক আছে।
মেজর মিজান : আচ্ছা, ঠিক আছে।
অডিও- দুই :
-স্লামালাইকুম।
মেজর (অব) মিজানুর রহমান মিজান : ওয়ালাইকুম সালাম। আচ্ছা, তোমার খবরের বার্তা কী? কদ্দুর কী করতে পারতেছো?
– ওই লোক ঠিক করছি। বাসাডা ঠিক করতে পারি নাই এখনও।
মেজর মিজান : একটা বাসা ঠিক করো। ২/৪/৫ হাজার যদি দিতেও হয়, দিয়ে দাও।
– মানে একটা বাসা ঠিক করে দেবো?
মেজর মিজান : মানে সেন্টারের পাশে। কথাটা বুঝছো?
-হ্যাঁ।
মেজর মিজান : এই লোকগুলিকে তোমাকে আনতে হবে…এই… তুমি রেডি থাকো। কয়জন লোক দিবা? একজন নাকি দুইজন?
– চারজন দেয়া যাবে, চার কেন্দ্রে চারজন। এক নম্বর ওয়ার্ডে চার-পাঁচ জন দেয়া যাবে।
মেজর মিজান : আচ্ছা, তোমার কথাটাই থাক। চার কেন্দ্রে চারজন। সাহসী ছেলে রেডি রাইখো। সাহসী যেন হয়। হাত-পা যেন না কাঁপে।
-এটা কোন সমস্যা না।
মেজর মিজান : হ্যাঁ। এগুলারে একটা গাড়ি নিয়া ঢাকায় চলে আসবা। ওদের আমি শিখাইয়া, ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দিবো। বুঝতে পারছো?
– হ্যাঁ।
মেজর মিজান: নাকি বুঝো নাই?
– না বুঝছি।
মেজর মিজান : ওদের নিয়া ওইখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসবা। ওদের আলাদা টাকা দিয়ে দিবো। কোন সমস্যা নাই।
-হ্যাঁ।
মেজর মিজান : ওদের শিখাইয়া দিতে হবে। একবার শিখাইয়া ওদের একবার-দুইবার ট্রেনিং দিতে হবে। বুঝতে পারছো?
– আচ্ছা।
মেজর মিজান : তুমি চারটা লোক রেডি করো। খাবার দাবার খাও। আমি আমার জিনিসপত্র রেডি করি। তুমি নিয়া আসবা। আমি বলবোনে কোথায় আসবা। গুলশানে, উত্তরায়, যে কোন জায়গায়, বুঝ নাই?
– হ্যাঁ ।
মেজর মিজান : তুমি ওদের নাম্বার-টাম্বার নিয়া রেডি করো। হাত খরচ দিয়া দিবনে। একবার-দুইবার ট্রেনিং দিয়া দিলে ঠিক হয়ে যাবে।
– ওকে।
মেজর মিজান : ওকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, টেলিফোনের অডিও-এর কণ্ঠস্বরটি মেজর (অব) মিজানের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তিনি। বিএনপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন এমন তথ্য পাওয়া গেছে তদন্তে।
তিনি আরো বলেন, লন্ডনে বসে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্দেশ দিয়েছেন যেভাবেই হোক গাজীপুরের নির্বাচনে নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড- চালাতে হবে। বিএনপির কর্মীদের আওয়ামী লীগের ব্যাজ পরিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী সাজিয়ে নির্বাচনী বুথে প্রবেশ করিয়ে জাল ভোট প্রদান ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে হবে।
এই ধরনের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার দৃশ্য ক্যামেরায় বা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে তা সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে দিতে হবে। বর্তমান সরকারের অধীনে বিশ্বাসযোগ্য কোন নির্বাচন সম্ভবপর নয় তা যাতে দেশে ও বিদেশে প্রচার করা যায়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে বানচাল ও বিতর্কিত করে নির্বাচন প্রত্যাখানের মাধ্যমে দেশব্যাপী জ্বালাও পোড়াও করে গণআন্দোলন গড়ে তুলে সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিকে ত্বরান্বিত করা যায়।
লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য টেলিফোনে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পৌঁছান বিএনপির কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাছে। মেজর (অব) মিজানের কণ্ঠ রয়েছে বলে আমরা বুঝতে পেরেছি। এ ছাড়াও ফজলুল হক মিলনের কণ্ঠস্বর থাকার সাদৃশ্যের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নির্দেশ দেয়ার ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে মেজর (অব) মিজানকে।
গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে জানা যায়, এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকেও ‘সংগঠিত’ করতে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক জিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের কথোপকথন ফাঁস হয়। পরে সেই অধ্যাপক মামুন সেই কথোপকথের কথা স্বীকার করে নেন।
নির্বাচনে জয়ী যে-ই হোক, একে প্রভাবিত করার এই অপচেষ্টা সত্যিই ঘৃণিত এবং নৈতিকতা বিবর্জিত একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে সঙ্গশ্লিষ্টতার উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে, তাদের সকলকে ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যেন ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ এ ধরনের অপরাধে জড়াবার সাহস না পায়।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply