একটা টি শার্ট, প্রতিবাদী একটা স্লোগান, এই সমাজের কতোজনের মুখোশ খুলে দিল। তবে আমার নিজের মতামত হলো, এসব প্রতিবাদ করে আর যেখানেই হোক অন্তত বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আরব দেশের পুরুষের সঙ্গে পেরে উঠবে না নারীরা।
কারণ এই দেশগুলোতে নারীদের এখনো যৌনবস্তু হিসেবেই দেখে। এখানে অধিকাংশ পুরুষ নারীর চোখ নয় শরীরের দিকে তাকায়। তাই হয়তো ‘গাঁ ঘেষে দাঁড়বেন না’, শুনলেই এদের চেতনাদণ্ড ক্ষেপে ওঠে।
সেই দণ্ড পুরুষতন্ত্রের। আমার বুঝে আসে না তুমি যদি কারও গা ঘেঁষে না দাঁড়াও তাহলে তো কথাটা তোমার জন্য নয়। তুমি তাহলে ক্ষেপলে কেন? কেন একটা ছোট্ট সহজ কথা বুঝতে পারো না, ভিড়ের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ, আর গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ানো এক নয়।
ইউরোপ, জাপান, মালয়েশিয়া কিংবা ব্যাংকক দুনিয়ার বেশ কয়েকটি শহরে আমি মেট্টোতে দেখেছি শত শত নারী পুরুষ একসঙ্গে চলাফেরা করে। মেট্টোতে তো গায়ে গায়ে লেগে যায়। কিন্তু সেখানে অধিকাংশ পুরুষের চোখে কামনা থাকে না।
মেয়েরাও স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। ইউরোপে মেট্টোতে আমি তীব্র ভিড় দেখিনি কিন্তু জাপান বা ব্যাংককে প্রায় সারাদিনই এতো ভিড় থাকে মেট্টোতে যে গায়ে গা লাগবেই। স্বাভাবিক মেলামেশা আর পোশাকের কারণে যদি নিপীড়ন হতো তাহলে তো এই শহরগুলোতে মেয়েরা ঘর থেকেই বের হত পারতো না।
কিন্তু আমি সেখানে দেখেছি পুরুষেরা ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকায় না মেয়েদের দিকে। কেউ কারও দিকে কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো। বাংলাদেশের অনেক মেয়েকে আমি বলতে শুনেছি, বিদেশে গিয়ে অচেনা কোন শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে তারা নির্ভয়ে চলতে পারে, রাস্তায় হাঁটতে পারে মধ্যরাতেও কিন্তু নিজ দেশের রাস্তাঘাটে বাসে গাড়িতে প্রকাশ্যে চলতেও ভয়াবহ যন্ত্রণা হয়। এই সমস্যার সমাধান তাহলে কী? নারীকে ঘরে বন্দি করে রাখতে হবে?
আমি বরং উল্টো করে বলি। আগেও বহুবার বলেছি। এখনো বলি সমাধান একটাই। এই দুনিয়ায় পুরুষ আর পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে মেয়েদের জিততে হলে, লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র হতে হবে শিক্ষা আর নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। রাজনীতি, ব্যবসা, প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ কিংবা ক্রীড়া ক্ষেত্র সর্বত্র নারীদের জয়জয়কার দরকার।
যতো বেশি করে নারীরা নেতৃত্ব স্থানে আসতে পারবে, যতো বেশি নারীর ক্ষমতায়ন হবে ততোই সমস্যা কমবে। একজন নারীর যদি নিজে আয় করতে পারে তাহলে তার জন্য অনেক লড়াই সহজ হয়ে যায়। কাজেই নারীর ক্ষমতায়নই সমাধান।
আর নারীর এই ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে দেশে আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে গেল। অনেকেই জেনেছেন, বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি নির্বাচিত হলেন রুবানা হক।
তিনিই বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতি। আমি বলবো এ আরেক ধাপ অগ্রগতি। তবে তার এই লড়াইটা কিন্তু একদিনের নয়।
মেয়র আনিসুল হক বলতেন, তার আনিসুল হক হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রুবানা হকের। আমরা কতোজন রুবানা হকের লড়াইয়ের কথা জানি? সেই কৈশোর বয়সেই টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়েছেন। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক দুটোতেই স্ট্যান্ড করেছেন। শিক্ষকতা দিয়ে পেশা শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে ব্যবসা। অথচ আনিসুল হকও শুরুতে চাইতেন না রুবানা ব্যবসায় আসুন।
রুবানা হক নিজেও গণমাধ্যমে সেই কথা বলেছেন। তিনি তখন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতেন। পড়ানোটা উপভোগ করতেন। আনিসুল হকের ব্যবসাও ভালোই চলছিল। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের চাপে আনিসুল হকের উচ্চ রক্তচাপ কমছিল না। এর মধ্যে একদিন চিকিৎসকের কাছে গেলেন তারা।
চিকিৎসক বললেন, ব্যবসার কিছু দায়িত্ব তো ভাবিকে দিলেই পারেন। কথাটি বেশ মনে ধরল আনিসুল হকের। বাড়িতে ফিরে আনিসুল হক ব্যবসার কাজে রুবানার সাহায্য চাইলেন। সেসময় আনিসুল হকের ব্যবসায়িক অংশীদারদের কারও স্ত্রী ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন না। তারা কেউ অফিসে আসতেন না। রুবানা শুরুতে মতিঝিলের অফিসে গিয়ে বসে থাকতেন, টুকটাক কাজ করতেন। ধীরে ধীরে ব্যবসার কাজে যুক্ত হলেন। বর্তমানে ২১টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি।
মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হকের কয়েকটা পোশাক কারখানায় গিয়েছি। ওই যে বললাম নারীর অগ্রগতির জন্য চাই শিক্ষা আর আর্থিক ক্ষমতায়ন, সেই দুটোর ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।
আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম জেনে, পোশাক কারখানার মেয়েদের যারা কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সাহস পেতেন না, তাদের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপাড়া করানোর একটা বিশাল কাজ শুরু করেছেন রুবানা হক।
আমি মনে করি এভাবেই লড়াই করতে হবে। কোন মেয়ে যখন বলে স্বামী সংসার সন্তান এসব সামলে লেখাপড়া, চাকরি ব্যবসা করতে পারি না। আমার মনে হয়, এগুলা শুধুই প্রচলিত পুরুষতন্ত্রের বাহানা। কিন্তু লড়াই করতে চাইলেই যে করা যায় সেই প্রমাণ আমাদের চারপাশে অনেক আছে।
রুবানা হকও স্বামী সন্তান সামলেছেন। সন্তান মারা গেছে। সেই কষ্ট সামলে আবার লড়াই করেছেন। পিএইচডি করেছেন। এসব করেই তো তিনি ২১টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েছেন। হয়েছেন দেশের প্রথম নারী বিজিএমই সভাপতি। আমি মনে করি এভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন দরকার।
তবে হ্যাঁ, আমি চাই পৃথিবীটা মেয়েদের জন্য সুস্থ ও নিরাপদ বাসযোগ্য হয়ে উঠুক। পথে-ঘাটে-অফিস-স্কুল, বাড়িতে কোথাও একটি মেয়েও শারীরিক ও মানসিক কোনোভাবেই যেন নির্যাতিত না হয়। আমার পুরুষ বন্ধুদের বলবো, আমরা নারীদের এগিয়ে না নিতে পারি অন্তত যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করি।
আমরা যদি সাহায্য নাও করি, নারীকে যদি বাঁধা না দিয়ে থাকি তার মতো চলতে দেই, তবু দেখবেন নারীরা এগিয়ে যাবে।
আর দুনিয়ার সব মেয়েকে বলি, বন্ধুরা, আপনি যেই হন না কেন, রাষ্ট্রপতির বউ, মেজর জেনারেলের বউ, ডিসির বউ, এসপির বউ কিছুতেই কিছু এসে যায় না। মনে রাখবেন আপনিই রাষ্ট্রপতি, জেনারেল, ডিসি সব হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আবারও বলছি, মনে রাখবেন, আপনার যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া কখনই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। শুভ কামনা সব নারীর জন্য।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply