জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপে পাঁচটি নতুন আবাসিক হলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সাড়ে চারশ’ কোটি টাকা।
আর এই টাকা থেকে ঈদুল আজহার আগে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চলমান ক্যাম্পাস উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দেবে না, এই প্রতিশ্রুতিতে ছাত্রলীগ নেতাদের এই টাকা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে টাকা দেয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের সাথে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামসহ প্রকল্পের ঠিকাদাররা অস্বীকার করলেও শাখা ছাত্রলীগের অন্তত ১৫ নেতা-কর্মী সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি স্বীকার করে জানিয়েছেন, ‘ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপকে দেয়া এক কোটি টাকার ভাগ তারাও পেয়েছেন। আর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।’
এদিকে ক্যাম্পাসের সর্বত্র এখন এই দুই কোটি টাকার আলোচনা। শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু কে কত করে ভাগ পেয়েছে? জানা যায়, ‘ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীরা ৫ থেকে ১ হাজার টাকা করে ভাগ পেয়েছেন। আর পদধারী নেতারা ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা করে পেয়েছেন।’
এসব বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করার কথা স্বীকার করলেও টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার ব্যাপারে কথা বলতে সংগঠনটির সভাপতিসহ অন্যরা আমার কাছে এসেছিলেন। তার মানে এই নয় যে, এখানে অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে।’
ভিসি বিষয়টি স্বীকার না করলেও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের এমন এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপের চার নেতাসহ ভিসির সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। সে সময় ভিসির পরিবারের দুই সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে কে কত টাকা পাবে সে বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে দর কষাকষি হয়েছিল। সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে এই দর কষাকষি শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সভাপতি ৫০ লাখ, সাধারণ সম্পাদক ২৫ লাখ এবং সাধারণ সম্পাদকের বিদ্রোহী গ্রুপ ২৫ লাখ করে টাকা পাবে।
এই তিনটি গ্রুপের মধ্যে একটির নেতৃত্বে রয়েছেন জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল রানা, অপর গ্রুপের নেতৃত্বে সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান চঞ্চল এবং তৃতীয় গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছেন যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং সহ-সভাপতি নাঈমুল হাসান তাজ।
ছাত্রলীগের এই তিনটি গ্রুপের বিরোধের জেরে গত ১০ মাসে কমপক্ষে ক্যাম্পাসে ৭ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে তিনটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অন্তত ১৫০ জন আহত হয়।
এদিকে জানা যায়, প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পুরো এক কোটি টাকা অর্ধেক করে ভাগ করে নেবেন।
কিন্তু গত ৭ আগস্ট তৃতীয় অংশের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে বৈঠক করার পর হিসাব পাল্টে যায়। একমতে পৌঁছতে তিন অংশের নেতারাই পরে ৯ আগস্ট ভিসির বাসায় বৈঠকে বসেন।
বৈঠকে তৃতীয় গ্রুপটি প্রস্তাব করেন, ‘যেহেতু তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের গোলাম রব্বানীর অনুসারী, সেহেতু তাদের এক কোটি টাকার অর্ধেক দিতে হবে। তবে জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
পরে ভিসির মধ্যস্থতায় বিষয়টি ‘নিষ্পত্তি’ হয় বলে জানা যায়। পরে সিদ্ধান্ত অনুসারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে দেয়া হয় এক কোটি, শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানাকে দেয়া হয় ৫০ লাখ, সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে ২৫ লাখ ও সাধারণ সম্পাদকের বিদ্রোহী গ্রুপের নেতাদের দেয়া হয় ২৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে স্বীকার করলেও টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা টাকা নিয়েছি এমন অভিযোগ মিথ্যা।’
জাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ানের সঙ্গে কয়েক দফা চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং সহ-সভাপতি নাঈমুল হাসান তাজ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জাবির পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নে’ ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রথম পর্যায়ে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
নির্মাণ প্রকল্পের জন্য সবুজ ক্যাম্পাসটির প্রায় ১ হাজার ১৩২টি গাছ কেটে ফেলার জন্য চিহ্নিত করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০০ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
এদিকে বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো এই দুই কোটি টাকা ও ক্যাম্পাসের গাছ কাটা। বিপুল পরিমাণ এই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা লাগাতার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন।
মঙ্গলবার তারা এক মশাল মিছিল করে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ পর্যন্ত ভিসিকে দাবি মেনে নেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে তাদের তিন দফা দাবি মানা না হলে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর ভিসির কার্যালয় অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
তাদের তিন দফা দাবি হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের হলের জায়গা স্থানান্তর করে পুনর্বিন্যাস সাধন করতে হবে, প্রকল্প নিয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে তার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে, মাস্টারপ্লানের পুনর্বিন্যাস করে প্রকল্পের বাকি কাজগুলো শুরু করতে হবে।
এছাড়া গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ এক সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অবস্থাকে ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন, সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানান।
এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, ‘এটা (ভাগ-বাটোয়ারা) তো রীতিমতো চমকে যাওয়ার মতো বিষয়।
শুনে অবাক হচ্ছি। আমরা প্রথম থেকে সত্যিকার অর্থেই উন্নয়ন চেয়েছি। কিন্তু এখানে টাকা ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি শুনছি সেটাতে আমরা আশঙ্কা করছি ক্যাম্পাসে হানাহানি সৃষ্টি হবে। একটা অশুভ চক্র তৈরি হয়ে যায় কি না সেটাও শঙ্কার বিষয়।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে হরিলুটের একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই এটা প্রতিহত করতে পারছি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চের মুখপাত্র সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘টাকা ভাগাভাগির যে অভিযোগ উঠেছে তা আশঙ্কাজনক। অভিযোগ সত্য হলে জনগণের করের টাকা হরিলুটে ব্যস্ত প্রশাসন। আমরা এই লুটপাটের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন।
সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন
Leave a Reply