উত্তর জনপদের ঐতিহাসিক নাটোর শহরে উচ্চ শিক্ষার প্রথম বিদ্যাপিঠ হিসেবে ‘নাটোর কলেজ’ গড়ে ওঠে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে । ইতিহাসের পাতা থেকে সঠিক জন্ম তারিখটি পাওয়া যায় ০১ জুলাই, ১৯৫৬ খ্রি: হিসেবে। এরপর ১৯৫৯ খ্রিঃ এর নামকরণ হয় ‘নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ’। অতপর ০১ মার্চ ১৯৮০ খ্রি: কলেজটি সরকারিকরণ হয়। ’নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারি কলেজ’, নাটোর এর মূল ভবনটি ইংরেজি ’ঊ’ টাইপের। এ ছাড়াও বর্তমানে এ কলেজে রয়েছে আরো দৃষ্টি নন্দন একাডেমিক ভবন।
নাটোরের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং মহকুমা প্রশাসক জনাব এম. হোসেন এর পৃষ্ঠপোষকতা আর উদ্যোগে ০১ জুলাই ১৯৫৬ খ্রিঃ ‘নাটোর কলেজ’ স্থাপিত হয়। আর ১৯৫৬-১৯৫৭ শিক্ষাবর্ষ থেকেই কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। অল্প কিছুদিন নাটোর জিন্নাহ হাই স্কুলে (বর্তমানে নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) ক্লাস চলার পর শহরের শুকুলপট্টিস্থ শুকুলদের পরিত্যক্ত বাড়িতে অস্থায়ীভাবে কলেজটি স্থানান্তরিত হয়। সূচনায় ‘নাটোর কলেজ’ হিসেবে নামকরণ করা হলেও পরবর্তীতে গভর্নিং বডির সভাপতি মহকুমা প্রশাসক জনাব আব্দুর রব চৌধুরী ১৯৫৯ খ্রিঃ এক সভায় ‘নাটোর কলেজ’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ’ নামকরণের প্রস্তাব করেন। যেহেতু ২৩ জুন ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে নবাবের পদাতিক সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার, আঠার হাজার অশ্বারোহী ও তেপান্নটি কামান আর ইংরেজদের পক্ষের সেনা সংখ্যা তিন হাজার ও কামান নয়টি। নবাব পক্ষে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫০০ এবং ইংরেজ পক্ষে নিহতের সংখ্যা ২২ জন ও আহত ৫১ জন। এই যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হয়। সেহেতু বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতার জন্য নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার বীরোচিত সংগ্রাম ও আত্মদান নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার মূল্য অনুধাবনে অনুপ্রেরণা যোগাবে- এই প্রত্যাশা থেকে উদ্যোক্তাগণ কলেজের নামকরণ করেন ‘নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ’। তাই গভর্নিং বডির সাথে আমরাও মনে করি ‘নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ’ নামকরণ যথার্থই হয়েছে।
৩১ মার্চ ১৯৬০ খ্রিঃ নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ নামে বর্তমান স্থানে ইংরেজি ‘ই’ (ঊ) বর্ণের আদলে কলেজের একমাত্র ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক জনাব সামসুর রহমান খান। জানা যায়, কলেজের নক্শা প্রণেতা ছিলেনতৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব-এ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (ঝ.ঙ) জনাব মোঃ আবুল হোসেন। ১৯৬১ খ্রিঃ শেষের দিকে শুকুলপট্টি থেকে কলেজের দৃষ্টি নন্দন একাডেমিক ভবনে কলেজটি স্থানান্তর হয়। কলেজটি শহরের প্রাণকেন্দ্র বড়গাছা মৌজার অর্ন্তগত। নাটোর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পূর্বদিকে প্রায় কোয়াটার কিলোমিটার রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত। শহরের প্রাণকেন্দ্র কোলাহল মুক্ত সবুজ বৃক্ষরাজী শোভিত বড়গাছা এলাকায় প্রায় ৩৪ বিঘা জমির ওপর নির্মিত কলেজের পুরো কাঠামোটি প্রাচীন নারোদ নদ দ্বারা দুই ভাগে বিভক্ত। এর বাইরেও কলেজের নামে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার অধিবাসী শ্রীযুক্ত মনশ্যাম দাস আগরওয়ালা এবং শ্রীযুক্ত রাধা কিষণ আগরওয়ালার দানকৃত ৭৮ বিঘা আবাদি জমি রয়েছে। নাটোর কলেজ গড়ে তোলার পেছনে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব আব্দুর রব চৌধূরী, জনাব লুৎফর রহমান খান, জনাব পীয়ার আলি নাজিরসহ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক এবং এ কলেজের কয়েকজন অধ্যাপকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ ছিল নাটোরের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নাটোরে ‘জয় বাংলা বাহিনী‘ গঠন হয়। শুকুলপট্টিস্থ কলেজ হোস্টেলের প্রশিক্ষণ মাঠে (বর্তমানে রাণী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজ) কলেজের চঘঈঈ (পাকিস্থান ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) বর্তমানে ইঘঈঈ (বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) এর কাঠের তৈরী ডেমী রাইফেল দিয়ে এ বাহিনীর ট্রেনিং হয়। এ ছাড়াও পাকিস্থানি বাহিনীর প্রতিরোধ কল্পে ছাত্র নেতৃবৃন্দ কলেজের রসায়ন বিভাগের রাসায়নিক দ্রব্যাদি দিয়ে বোমা বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। সে সময় প্রশিক্ষণরত যোদ্ধাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল অত্র কলেজ হোস্টেলে। মুক্তিযুদ্ধে এই কলেজের অবদান অসামান্য, যা ইতিহাসে অ¤øান হয়ে থাকবে।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ কলেজের যে সকল ছাত্র শহীদ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে কলেজ ছাত্র সংসদের ১৯৬৩-১৯৬৪ শিক্ষাবর্ষের প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি (ঠ.চ) খন্দকার রেজাউন নবী, আমিরুল ইসলাম বাবুল, মাহবুব আলী সেলিম, মজিবর রহমান রেজা, গোলাম রাব্বানী রঞ্জু, আব্দুর রহমান খান সেলিম চৌধুরীর নাম সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকা এদেশের ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে।
অবশেষে আলো ছড়ানো প্রশান্তিময় ১৯৮০ খ্রিঃ ০১ মার্চ সরকারিকরণের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখা হলো স্মৃতির অ¤øান প্রচ্ছদে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জ্ঞানালোকে সমুজ্জ্বল হয়ে অদ্যাবধি অবিরাম জ্ঞান প্রদীপ ছড়িয়ে যাচ্ছে এ কলেজ। আধুনিককালের ধুলি-ধুসরিত এ শহরটির সাথে জড়িয়ে আছে এ জনপদবাসীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রায় বিস্মৃত এক অধ্যায়। জাতীয় চেতনা সমৃদ্ধ এ জনপদে ‘নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজ’ এর প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
সংকলকঃ সাবেক উপাধ্যক্ষ, নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারি কলেজ নাটোর, বীরমুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক, সমাজসেবক ও সৃষ্টিশীল কাজের অন্যতম সংগঠক।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
খবরটি যদি গুরুত্বপুর্ন মনে হয় তাহলে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার করুন
Leave a Reply