একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দেয়ার পরও জাতীয় সংসদে যোগ দিয়েছে বিএনপি। দল থেকে বলা হচ্ছে- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই সংসদে যোগ দিয়েছেন দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তারেক রহমানের অনুমোদনেই যদি দলের নির্বাচিতরা সংসদে যোগ দেবেন, তাহলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচিত হয়েও কেনো যোগ দিলেন না। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ফাঁদে পড়ে গেছেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা দৈনিক জাগরণকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়া পর প্রথম প্রথম দল পরিচালনায় তারেক রহমান তেমন একটা হস্তক্ষেপ না করলেও এখন তার পরিমাণ বেড়ে গেছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে হাতে ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনে যাওয়া এবং তার আগে ঐক্যফ্রন্ট গঠন, এই দুইটার একক কর্তৃত্বের কারণেই স্থায়ী কমিটির সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিভাজন স্পষ্ট হয়। সেই বিভাজন নির্বাচন, মনোনয়নসহ সব প্রক্রিয়াতেই মির্জা ফখরুলের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থায়ী কমিটির বেশকিছু সদস্য খুব ভালভাবে নেননি।
নির্বাচনে বিএনপির বেশকিছু হেভিওয়েট নেতা নিজেদের মনোনয়নপত্রও দাখিল করেননি। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ব্যাপক পরাজয়ের দায়ভার যেটা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও বরকত উল্লাহ বুলুর টেলিকনফারেন্স যেটা ফাঁস হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট হয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে মির্জা ফখরুলের সম্পর্কের চরম অবনতি।
দ্বিতীয়ত: ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে মির্জা ফখরুল প্রথম সমন্বয়কারী থাকলেও তিনি পরবর্তীতে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু গয়েশ্বর সেই কমিটিতে যেতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে ড. মঈন খানকে দিয়ে বিএনপি এখন প্রতিনিধিত্ব করাচ্ছে। এসব কিছু নিয়ে মহাসচিব কোণঠাসা ছিলেন।
সুলতান মনসুর ও মোকাব্বিরের শপথের পর ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিএনপিকে বের হয়ে আসতে হবে- এটা প্রকাশ্য দাবি ছিল মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বের চন্দ্র রায়ের। মৌন সমর্থন ছিল ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের। একই সঙ্গে ২০দলীয় জোটে জামায়াত থাকার কারণে মির্জা ফখরুল ২০দলকে আপাতত কোনো কর্মসূচি বা সিদ্ধান্তের জায়গায় আনতে চাচ্ছেন না। এটা নিয়েও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একটি বড় অংশ নাখোশ। নীতি-নির্ধারণী জায়গায় ভোটের হিসাব ও নানা অংকের চিন্তা করে মির্জা ফখরুলকে সহযোগিতার হাত বন্ধ করে দিয়েছেন এসব নেতা। এগুলো সঙ্কটের কিছু কিছু জায়গা।
সূত্র মতে, সর্বশেষ সংসদে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে মির্জা ফখরুলের সিদ্ধান্ত ছিল যে, সংসদে কেউ যাবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এটা তার কাছ থেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে। এতে তিনি বুঝে গেছেন, যে আগামীতে হয়তো আরও বড় সিদ্ধান্ত তার ব্যাপারেও আসবে। সে সময় মানুষের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হবে সংসদে যাওয়ার বিষয়ে মির্জা ফখরুল অন্যতম ব্যক্তি। সেজন্য তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে সংবাদ সম্মেলনে সংসদে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও তিনি নিজে শপথ নেননি, সংসদেও যাননি। নানান হিসাব নিকাশ করেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ মানেননি। এটা পরিষ্কার তারেকের সিদ্ধান্তেই বিএনপি সংসদে গেছে কিন্তু তারেকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি মহাসচিব। তিনি যোগ-বিয়োগ করেই ফাইনালি বুঝে নিয়েছেন, যেহেতু ওখান থেকে সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছেন, ভবিষ্যতে হয়তো আরও এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসবে, অতএব তিনি নিজেকে নিরাপদ রাখতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেয়ার পর দল মনে করেছিল বাকী নির্বাচিতরাও শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকবেন। কিন্তু শপথ নেয়ার পক্ষে দলের নির্বাচিতদের অনঢ় অবস্থান দলের ভেতর অস্বস্তি তৈরি করে। স্থায়ী কমিটি শপথের বিপক্ষে কঠোর মনোভাব নিলেও এসব নির্বাচিতরা দলের যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে শপথের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা দলের হাইকমান্ডকে জানিয়ে দেন। এক পর্যায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি এসব নির্বাচিতদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে তিনি তাদের শপথ গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেন।
তারেক রহমানের এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
সূত্র আরও জানায়, সংসদে যোগ দেয়া ও এ শপথের মধ্য দিয়ে পুরো বিএনপিকে যে ঝাঁকুনি দিয়েছে, নেতা-কর্মীদের মনে যেভাবে গেঁথে গেছে তা গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের অকল্পনীয় পরাজয়ও এতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ নির্বাচনে কি ঘটেছে তা দেশবাসী ও নেতা-কর্মীরা খুব ভাল করেই জানে। কিন্তু সংসদের ৯০ দিনের মধ্যে ৮৫ দিন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, ফখরুল ইসলামের মতো হেভিওয়েট নেতারা সংসদে না যাওয়ার পক্ষে ব্যাটিং চালিয়ে হঠাৎ করে ডিগবাজি খেলেন, তা নেতা-কর্মীদের ব্যাপক হতচকিত করেছে। এসব হেভিওয়েট নেতাদের তো জাতির সামনে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে তো শপথ করার দরকার নেই। তাদের মুখের কথাই যথেষ্ট। সে জায়গায় বিএনপির সিদ্ধান্ত যখন এরশাদ ও জাতীয় পার্টির মতো ঘটে গেলো, তখন তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। আগের দিন জাহিদকে বহিস্কার করল, স্কাইপিতে স্থায়ী কমিটির সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক। ঠিক একদিনের মধ্যে কি ঘটনা ঘটে গেল, তা রহস্যই রয়ে গেল। সব কিছু মিলেই বিএনপি মহাসচিব বেশ অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন।জানা যায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আবদুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান দলের মহাসচিবের সঙ্গে একাত্ব আছেন। সে কারণে দলের মধ্যে ফখরুল বিরোধী অংশের প্রভাবই বেশি।
এদিকে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেবার সময়সীমার শেষদিনেও শপথ না নেয়ায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সংসদীয় আসন ইতোমধ্যেই শূন্য ঘোষণা করেছেন স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী।
শুরু থেকেই শপথ না নেবার কথা বলে আসছিল বিএনপি, তাই তাদের শেষ দিনে শপথ নেয়া অনেককেই অবাক করেছে। কারণ বিএনপির লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মির্জা ফখরুলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সবাই বলছিলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কোন নির্বাচনই হয়নি তাই এতে বিজয়ী বিএনপির নেতারা শপথ নেবেন না।
কিন্তু সে অবস্থান নাটকীয়ভাবে উল্টে দিয়ে বাকিরা শপথ নিলেও মির্জা ফখরুলের শপথ না নেয়াটা হয়তো অনেককে আরও বেশি বিষ্মিত করে যখন মির্জা ফখরুলই সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির এমপিদের শপথ নেবার বিষয়টি জানান।
মির্জা ফখরুল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কৌশলের অংশ হিসাবে’ তিনি শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ কৌশল হচ্ছে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কাজ করা। সে কারণে সংসদের বাইরে থেকে আমি দলের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটা দলেরই একটি কৌশল। যারা শপথ নিয়েছেন তারা সংসদের ভেতরে কাজ করবেন, আমি বাইরে থেকে কাজ করবো।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, আমি তো এখানে কোন কৌশল দেখি না। কৌশল মানে কি, সরকারের কাছ থেকে কিছু আদায় করা তো? যেমন খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি। তো, উনি (মির্জা ফখরুল) সংসদে গেলে বা না গেলে সরকারের কি আসে যায়?
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন খুবই ‘কনফিউজিড’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ হয়ে গেছে। বিশেষ করে মনে হচ্ছে বিএনপি দলটির কোন দিক-নির্দেশনা বা নেতৃত্ব বলতে কিছুই আর নেই। তারা যে কথা বলে সেই মতো কাজ করে না।
দিলারা চৌধুরী আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে তো বিএনপির মধ্যে আগে থেকেই মতপার্থক্য ছিল। এক পক্ষ নির্বাচনে না যাওয়া এবং আন্দোলনের পক্ষে ছিল, আরেকটা গ্রুপ হচ্ছে মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন- যারা নির্বাচনে গেছে।
তিনি বলেন, এখন বিএনপির যে এমপিরা শপথ নিয়েছেন এটা কিন্তু বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা খুব ভালো চোখে দেখবে না, তাদের সমর্থন তারা হারাবেন, কারণ তারা অনেক হামলা-জুলুম সহ্য করেছেন। বরং এখন যেটা হতে পারে যে যদি দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকতে পারে-তাহলে দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতাদের ভেতর থেকেই দলটির একটা নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে পারে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় অবশ্য বলেন, যদি তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই পাঁচ এমপি শপথ নিয়ে থাকেন তাহলে তো শপথ না নিয়ে মির্জা ফখরুল আসলে তারেক রহমানের নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন।
এর আগে পর্যন্ত বিশ্লেষকদের মত ছিল, নির্বাচনে জয়ী বিএনপির অন্য নেতারা যদি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ ভঙ্গ করে শপথ নেন- সেক্ষেত্রে দল তাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য বহিষ্কার করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা জানান, দলটির নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাই নির্বাচিত হয়েছেন, ফলে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অনেকে তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারও কারও সাথে তার টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি বলেন, স্থায়ী কমিটির সব সদস্যই শপথ নেয়ার বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। ফলে এখন সংসদে যাওয়ায় ফখরুলের সঙ্গে তাদের সেই টানাপোড়েন বাড়তে পারে।
বিএনপির আরেকজন নেতা বলেন, যেহেতু বিএনপির মহাসচিব দলের পক্ষে এতোদিন কঠোর অবস্থানের কথা বলে আসছিলেন, ফলে এখন তিনিও একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। স্রোতের বিপরীতে সংসদে গিয়ে তার যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ছিল, সেটা কতটা সম্ভব ছিল তা নিয়েও দলের মধ্যে সন্দেহ ছিল।
ওই নেতা জানান, সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব তারেক রহমানের হলেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার ঘনিষ্ট কয়েকজন নেতাকে জানান, বিষয়টাতে তার ব্যক্তিগতভাবেও সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা বিষয় আছে।
সূত্র জানায়, দলের নেতৃত্বে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যই সংসদে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply