রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। বাস্তুচ্যুত হয়ে রাখাইন রাজ্যে শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা না হলে ত্রাণ সহায়তা বন্ধের এই হুমকি দেওয়া হয়েছে।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের জাতিবিদ্বেষী নীতির কারণে ত্রাণ সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে সংস্থাটি। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কেনাট ওস্টবি নেপিদোকে চিঠি দিয়ে এ বার্তা জানিয়ে দিয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়ে যে রোহিঙ্গারা এখনো রাখাইনের শরণার্থী শিবিরে (ইন্টারন্যালি ডিসপ্লেসড পার্সনস-আইডিপি ক্যাম্প) থেকে গেছে, তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। মিয়ানমার অবশ্য চিঠিটিকে হুমকি হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের দাবি, ওই চিঠিতে সহায়তার বার্তা দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনে ক্যাম্পে বসবাস করছে।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। জাতিগত নিধনের ভয়াবহ বাস্তবতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশটি বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও জাতিসংঘের হিসাবে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ এখনো সেখানে থেকে গেছে। দ্য গার্ডিয়ানের হিসাব অনুযায়ী, রাখাইনে থাকা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।
২০১২ সালে রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য স্থাপন করা হয় আইডিপি ক্যাম্প। তখন থেকেই এই ক্যাম্পে সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা ও কামান জনগোষ্ঠীর প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার সদস্য এসব ক্যাম্পে বসবাস করে। তবে তাদের চলাফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে মিয়ানমার সরকার। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাবিরোধী নতুন অভিযান জোরালো করার পাশাপাশি এসব ক্যাম্প বন্ধ শুরুর অঙ্গীকার করে মিয়ানমার সরকার। তবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। উল্টো অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও অবনতির দিকে গেছে।
সেই ২০১৮ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হওয়া এসব মানুষ সেখানকার শিবিরে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। সংস্থাটির ত্রাণবিষয়ক উপ-প্রধান উরসুলা মুলার সে সময় দাবি করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি মনোযোগী হলেও রাখাইনে থেকে যাওয়া ওই চার লাখ রোহিঙ্গা আলোচনার বাইরে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের বাস্তবতাকে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যা দিয়ে রাখাইন পরিস্থিতি উন্নয়নের তাগিদ দেন তিনি। একপর্যায়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সম্মত হয় মিয়ানমার।
ওই কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, স্বেচ্ছায় ও আলোচনার ভিত্তিতে এসব ক্যাম্পে বসবাসকারী ব্যক্তিদের নিজেদের গ্রাম বা আশপাশের সম্ভাব্য কোথাও পুনরায় বাসস্থান তৈরি করে দিতে হবে, যেখানে তারা জীবিকার সুযোগ পাবে। তবে জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন ও মানবিক সংস্থাগুলোর বর্ণনা থেকে গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে, আইডিপি ক্যাম্পগুলোতে রুদ্ধশ্বাস বাস্তবতা চলছে। সেখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও দুর্দশা অপরিবর্তিত রয়েছে। চলাফেরা, জীবিকা উপার্জনের সুযোগ প্রায় পুরোপুরিই অস্বীকার করা হয়েছে।
গত ৬ জুন মিয়ানমার সরকারকে লেখা চিঠিতে দেশটিতে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেছেন, এখন থেকে চলাফেরার স্বাধীনতাসহ মৌলিক ইস্যুতে বাস্তব উন্নতি হলেই কেবল জাতিসংঘ ও তাদের দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা সরবরাহ করা হবে। মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয়ে-কে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পুরনো ‘বন্ধ থাকা’ এবং নতুন তৈরি করা ক্যাম্পগুলোতে একই অমর্যাদাকর পরিস্থিতি চলছে। সেখানকার বাসিন্দাদের মৌলিক সেবা বা জীবিকার সুযোগ নেই। এমনকি দৃশ্যত অপরিবর্তিত থেকে গেছে ক্যাম্পের অবস্থান।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘ-বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে। তবে মুখে প্রত্যাবাসনের কথা বললেও মিয়ানমার শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। একদিকে তারা বুলডোজারে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত নষ্ট করেছে, চলমান রেখেছে রোহিঙ্গাদের ভূমিতে ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ নির্মাণের প্রক্রিয়া; অন্যদিকে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ভান করে গেছে। ত্রাণ বন্ধের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে মিয়ানমারে কর্মরত জাতিসংঘের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্প বা তার আশপাশে স্থায়ী বাড়িঘর নির্মাণে সরকারি পরিকল্পনায় এটা স্পষ্ট, জাতিবিদ্বেষী বিচ্ছিন্নতা স্থায়ী হবে।
গার্ডিয়ানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আইডিপি ক্যাম্প বন্ধের কাজ আন্তর্জাতিক মানে আনতে জাতিসংঘ বেশ কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, এসব নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ওস্টবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও অস্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। তবে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক উপমন্ত্রী সোয়ে অং দাবি করেছেন, ওস্টবির চিঠিকে জাতিসংঘের সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি হিসেবে দেখছেন না তারা।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের সংস্থা এবং আমাদের মন্ত্রণালয় নিবিড় যোগাযোগ রাখছে আর মানবিক সহায়তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য আমরা খোলামেলাভাবে এবং বারবার আলোচনা করছি।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
খবরটি যদি গুরুত্বপুর্ন মনে হয় তাহলে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার করুন
Leave a Reply