সঙ্গীতাঙ্গনের অপরাজেয় নায়ক আসিফ আকবর। স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলা তার স্বভাব। দুই দশকের সঙ্গীত ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন অসংখ্য চড়াই-উতরাই। তবু নিজ সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। গড়েছেন এবং ভেঙেছেন অসংখ্য রেকর্ড। একইভাবে গায়কিতেও নিজেকে ভেঙেছেন বহুবার। শ্রোতার চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে দীর্ঘ পথচলা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গ নিয়েই এই সাক্ষাৎকার
রেকর্ডিং স্টুডিও, শুটিং স্পট, টিভি স্টেশন, অফিস, বাসা- এই যে প্রতিদিনের ছুটে চলা, ব্যস্ততা-এর মাঝে কখনও কি পেছনের দিনগুলোয় ফিরে তাকানোর সুযোগ হয়?
সামনের দিক ছুটছি, পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ কোথায়। কিন্তু এটাও ঠিক, অতীত ভুলে থাকা যায় না। কোনো না কোনোভাবে তা মনের মধ্যে হানা দেয়।
কেমন অনুভূতি হয় শিল্পীজীবনের সংগ্রাম, ক্রমাগত উত্থান, কোটি শ্রোতার হৃদয় জয় করে পেরিয়ে আসা দুই দশকের দিনগুলোর কথা মনে হলে…
অনুভূতি তো কথায় বোঝানো যায় না। তবে এটা বলতে পারি, পেছন ফিরে তাকালে স্বপ্নের মতোই মনে হয় সবকিছু। শিল্পী হবো- এমন ভাবনা ছিল না। অথচ এই আমি গানের জন্য কুমিল্লা ছেড়ে যখন ঢাকায় এসেছি, যার আত্মবিশ্বাস ছাড়া বড় কোনো পুঁজি ছিল না। সেই আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করেই দিনের পর দিন সংগ্রাম করেছি। প্লেব্যাক ও অ্যালবামের শিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছি। প্রথম অ্যালবামের সাফল্যের পরই ঘুরে গেছে ভাগ্যের চাকা। এরপর আরও কত ঘটনার জন্ম হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিটি ঘটনাই কোনো না কোনো সময় মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এই ঘটনাবহুল জীবন, শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা, সাফল্য আর অগণিত মানুষের ভালোবাসা পাওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়।
প্রথম অ্যালবাম ‘ও প্রিয় তুমি কোথায়’ সাফল্যের পর হঠাৎ করেই গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালকের সেটআপ বদলে ফেলার বিষয়টি কি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়নি?
আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ নই, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে চেয়েছি। প্রতিটি কাজে একটা ছক তৈরি করে নিয়েছি। পুরনো অনেক গীতিকার ও সুরকার ছিলেন, যাদের হাতে তখন কাজ ছিল না, তাদের সঙ্গে কাজ করেছি। জানতাম তারা নতুন কিছু করে দেখানোর জন্য মুখিয়ে আছেন, কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছে না। অন্যদিকে, নতুন অনেকে আছেন যারা নিজ প্রতিভা তুলে ধরতে চান। কিন্তু কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই তাদের। তেমনই কয়েকজন গীতিকার ও সুরকারদের নিয়ে কাজ করেছি এবং সবাই যার যার জায়গা থেকে সময়োপযোগী গান তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রচেষ্টায় আমরা যে সফল- এটা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না।
মিশ্র ও দ্বৈত অ্যালবামের শিল্পী নির্বাচন নিজেই করতেন। এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিল কি?
শুরুর দিকে কিছু শিল্পী মিক্সড ও ডুয়েট অ্যালবামে আমার সঙ্গে কাজ করতে চাননি। যে জন্য আমি একটা স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করেছি। পিয়াল হাসান আর আতিক বাবুকে নিয়ে ‘ভুলতে পারি না সাথী’, ‘কেমন আছ তুমি’সহ কয়েকটি অ্যালবাম করেছি। সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার পর কেউ শিল্পী নির্বাচন বিষয়ে কথা তোলেনি।
শূন্য দশকের মাঝামাঝি শোনা যেত সাউন্ডটেকের কর্ণধাররা আপনার দ্বারা প্রভাবিত। আসলেই কি তাই?
প্রভাবিত করিনি বরং তারা আমার ওপর যে আস্থা রেখেছিলেন তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সে সময় অনেক তারকাশিল্পী সাউন্ডটেক ছেড়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতায় চলে গিয়েছিলেন। চাইলে আমিও যেতে পারতাম। কিন্তু যাইনি। অনেক টাকার হাতছানি পায়ে ঠেলে দিয়ে টানা নয় বছর সাউন্ডটেকের হয়ে অ্যালবাম করে গেছি।
প্লেব্যাক বিষয়েও লোভনীয় প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলাননি। কারণ কী?
প্লেব্যাক আমার প্রাণের জায়গা। যে জন্য পাঁচ হাজার টাকায় সিনেমার গান করতে আপত্তি করিনি। তার চেয়ে বড় কথা, সে সময় বড় বড় প্লেব্যাক শিল্পী সাত-আট হাজার টাকায় গান করতেন। তরুণ শিল্পী হয়ে আমি নিশ্চয় তাদের চেয়ে পারিশ্রমিক বেশি চাইতে পারি না। চাইলে খ্যাতিমান শিল্পীদের এক ধরনের অপমান করা হতো। জনপ্রিয়তা বলে বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক নেব- এটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। অ্যালবাম প্রযোজকরা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সিনেমায় গান করে কত টাকা পাই। বলেছিলাম, সব মিলিয়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এ কথা শুনে তারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মাসে এক থেকে দুই লাখ টাকা আমাকে দেবেন, যদি আমি প্লেব্যাক না করি। কিন্তু তাদের এই প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দিয়েছি।
প্লেব্যাকের প্রতি এমন দুর্বলতার পরও এখন কেন সিনেমার গান করছেন না?
জেমস ও হাবিব নিয়মিত প্লেব্যাক শিল্পী না হয়েও বড় অঙ্কের পারিশ্রমিকে সিনেমায় গান করেছেন। তা দেখেও আমি আমার পারিশ্রমিক বাড়াইনি। তখন প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কিন্তু আগের নিয়মে কাজ করা সম্ভব নয়। প্রযোজকদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতেই এখন প্লেব্যাক থেকে দূরে আছি।
কাজের বিষয়ে আপনার এই একরোখা স্বভাব শুরু থেকেই ছিল?
ছিল, কারণ কিছু বিষয়ে কোনো রকম কম্প্রোমাইজ চলে না। আমিও করি না। এ কারণেই কেউ আমাকে জেদি, রাগী, একরোখা নয়তো প্রতিবাদী বলে থাকেন। মাজহার ভাই [গাজী মাজহারুল আনোয়ার] তো প্রায়ই বলেন, আসিফ ছেলেটি একরোখা, কিন্তু বেয়াদব নয়।
নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতেই কি গান থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন?
অনেকটা তাই। সে সময় শিল্পীর মেধাস্বত্ব নিয়ে আওয়াজ তুলেছিলাম। নিজেও আর্ব নামের নতুন কোম্পানি গঠন করে গান ও অ্যালবাম প্রযোজনা শুরু করেছিলাম। যে জন্য মেধাস্বত্বের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যখন আওয়াজ তুলেও কোনো ফল পাচ্ছিলাম না, তখনই গান থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও গান থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ভক্তদের কথা ভেবে আবার যখন গানে ফিরলেন, তখন কি আগের অবস্থান ফিরে পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন?
ভক্তদের জন্য গাইব- এটাই ছিল প্রথম চাওয়া। শিল্পী হিসেবে নিজের অবস্থান যাচাই করার কথা ভাবিনি। বিশ্বদা [কুমার বিশ্বজিৎ] যুগের পর যুগ সমান জনপ্রিয়তা ধরে রেখে গান করে যাচ্ছেন। এমনকি এখনও মিউজিক ভিডিওতে অংশ নিচ্ছেন, যা প্রতিনিয়ত আমাকে প্রেরণা দেয়। তাকে দেখেই প্রেরণা পেয়েছি কাজ করে যাওয়ার। তার মতো বড় মাপের শিল্পী হই বা না হই, চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছি। ভেবেছি, বিশ্বদা পারলে আমি কেন পারব না? সেই বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি এবং আগের মতো বিপুল সাড়া পাচ্ছি।
সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে আপনার ভাবনা এবং আগামী দিনের পরিকল্পনা কী?
গৎবাঁধা নয়, আর্ব থেকে নিয়মিত ভিন্ন ধাঁচের গান প্রকাশ করে যাওয়া এবং অ্যাপস নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করে যাচ্ছি। যাতে শ্রোতা এবং শিল্পী ও সঙ্গীতস্রষ্টার মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র তৈরি হয়।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন।
সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন
Leave a Reply