চিকিৎসা সেবা অনেক ক্ষেত্রে অনেকের জন্যে হয়ে উঠেছে শুধু একটি ব্যবসা। রোগীর আত্মীয় স্বজনের থেকে গলাকাটা ভিজিট নিয়ে রোগী ভর্তি করে নেয়া হয়, তবুও অনেক ক্ষেত্রে মিলছে না পরিপূর্ণ সুষ্ঠু সেবা। অথচ মানবসেবা ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন থাকে অনেকের। ছোটোবেলার রচনায় আমরা লিখি, বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই, মানব সেবার জন্য।
এবার এমনই এক মানবসেবী ডাক্তারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায় স্থানীয় প্রেসক্লাব। সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া গলি ধরে ৫০ গজ এগোতেই হাতের বাঁয়ে চোখে পড়ে একটি সাইনবোর্ড। লোহার ফটকের পাশে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো সে বোর্ডে লেখা পাঁচজন চিকিৎসকের নাম—বসন্ত কুমার রায়, তরুণ কুমার রায়, সুস্মিতা রায়, সুদীপ্তা রায় ও উদয় শংকর রায়। একসঙ্গে পাঁচজন চিকিৎসকের নাম দেখে মনে হতে পারে বাড়িটি কোনো বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক। আদতে তা নয়। এই চিকিৎসকেরা একই পরিবারের সদস্য। বাড়ির নিচতলায় একটি চেম্বার আছে। সেখানে বসেন বসন্ত কুমার রায়।
সদা ভিড় লেগে থাকে রোগীদের। যে দৃশ্য ৫০ বছর ধরে একই রকম। বসন্ত কুমার রোগী দেখা শুরু করেছিলেন ১ টাকায়। এখন দেখছেন ৪০ টাকা ভিজিটে। ‘তবু তা নির্ধারিত নয়’—বললেন, বসন্ত কুমার রায়। মানবসেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে চলা এই ডাক্তার আগামী ১১ মার্চ পূর্ণ করবেন তাঁর চিকিৎসাসেবার ৫১ বছর। বসন্ত কুমার রায়ের পথ অনুসরণ করেছেন তাঁর ছোট ভাই তরুণ কুমার রায়। তিনিও ৪০ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখেন। এমন অনেক কিছুই জানা হলো বসন্ত কুমার রায়ের কাছ থেকে।
যেমন জানা গেল, সাইনবোর্ডে লেখা বাকিদের পরিচয়—তরুণ কুমার রায় তাঁর ছোট ভাই। সুস্মিতা রায় ও সুদীপ্তা রায় বসন্ত কুমার রায়ের দুই মেয়ে। উদয় শংকর জামাতা, সুস্মিতার স্বামী। সুস্মিতা ও উদয় ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন। সুদীপ্তা রায় আছেন রাজশাহী শহরের একটি হাসপাতালে। তাঁদের দুই ভাইয়ের খুব স্বল্প ফিতে রোগী দেখার বিষয়টি দিনাজপুরের সবাই জানেন। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের চিকিৎসার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন দুই ভাই।
১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার (বর্তমান পঞ্চগড়) দেবীগঞ্জের সুন্দরদীঘি গ্রামে জন্ম বসন্ত কুমার রায়ের। বাবা মধুসূদন রায় ও মা অহল্লা বালা রায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি। বসন্ত দেবীগঞ্জের এনএনএইচ উচ্চবিদ্যালয় ও রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। ১৯৬৫ সালে সেখান থেকেই এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবনেই দিনাজপুরে রামকৃষ্ণ মিশনে যাতায়াত ছিল তাঁর। এমবিবিএস পাসের পর সেটা আরও বেড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘সে সময় রামকৃষ্ণ মিশনের দায়িত্বে ছিলেন মহারাজ অমৃত্ত নন্দ। মূলত তাঁর সংস্পর্শে এসে স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত হয়ে পড়ি।’ ভক্ত বসন্ত কুমার রায় শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দের জীবনচর্চা। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন মানবসেবায়। ১৯৬৬ সাল, তখনো তাঁর ইন্টার্নি চলছিল রাজশাহী মেডিকেলে। তখন ঠাকুরগাঁওয়ের কল্পনা রানীকে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে দিনাজপুরের ক্ষেত্রিপাড়ায় আবাস গড়েন। শুরু করেন চিকিৎসাসেবা।
সেই থেকে এতগুলো বছর কেটে গেলো আজ। পরের জন্যে মানব সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবার এই দৃষ্টান্ত ক’জন ডাক্তার ই বা দেখাতে পারেন?
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply