সরকার ৩৫ হাজার নদী দখলকারীকে চিহ্নিত করেছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের তালিকা প্রকাশ করার কথা চিন্তাভাবনা করছে। নদীসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতোমধ্যে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা এবং নদী রক্ষায় ১৭টি গাইড লাইন দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনার পর সরকার বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। তাই নদীর দখল ও দূষণ রোধে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। কেননা নদীর দখল ও দূষণের কারণে আমাদের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়া নদী দখল করে তীরে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে মিলকারখানা। এসব মিলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে মৎস্য ও কৃষির ওপর। তাই নিজেদের স্বার্থেই নদীকে বাঁচাতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৯ সালে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য প্রথম অভিযান শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে ১/১১ সরকার ক্ষমতায় আসায় সে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সরকার দখলদারদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে আবার নদীর দখলদারদের উচ্ছেদে পদক্ষেপ নেয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে গতকাল বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে নদী দখল এবং দূষণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় নদী রক্ষায় বিআইডব্লিটিএর উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে। আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় উচ্ছদ অভিযান শক্তিশালীভাবে করা যায়নি। কিন্তু এবার সকলের সমন্বয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী অভিযান পরিচালনা করা হবে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ আছে কিছু কোম্পানি রয়েছে যাদের কারখানা নদীর তীরে। তাদের কারখানায় ইটিপি আছে কিন্তু তারা ইটিপি সব সময় চালু রাখে না। যখন সরকারি লোকজন পরিদর্শনে যায় তখন তারা ইটিপি চালু রাখে, আবার যখন তারা চলে যায় তখন তারা ইটিপি বন্ধ রাখে। তখন আইন সচিব বলেন ওই কারখানাকে বন্ধ করে দিতে হবে। দূষণকারী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও টাস্কফোর্সের সভাপতি খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এ সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল হালিম, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক, পরিবেশ সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, বিআইডব্লিউর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একেএম রফিক আহমেদ, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
সভায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নদী তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘টাস্কফোর্স কার্যক্রম ভূমিকা রাখবে। উচ্ছেদ কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা করার জন্য তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, নদী রক্ষায় আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার আমরা সবই করবো।
আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক বলেন, নদী দখল উদ্ধার না করলে দেশ শেষ হয়ে যাবে। নদী দখল উদ্ধার ঐতিহাসিক কাজ। যারা ইটিপি ব্যবহার করবে না ওই সব কোম্পানির কারখানা বন্ধ কওে দেওয়া হবে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ৫৫ জেলার ডিসি আমাদের কাছে দখলদারদের তালিকা দিয়েছে। এতে দেখা গেছে ৩৫ হাজার দখলদার নদী দখল করেছে আছে। ১৫ দিনের মধ্যে ওয়েবসাইটে এদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, নদীর দখল উদ্ধারে আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট ও ফান্ড দরকার। জবাবে নৌ সচিব মো. আবদুস সামাদ বলেন, ফান্ড কোনো সমস্যা নয়। যা দরকার তাই দেওয়া হবে।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, নদী তীরের ছোট ছোট কারখানা যারা তাদের বর্জ্য নদীতে ফেলে ওই সব কারাখানা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন- কারখানাগুলো যে ইটিপি তৈরি করেছে তা ভালো হয়নি। খুবই দুর্বল প্রকৃতির ইটিপি বানানো হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এবং বুয়েটের তদারকি দল এগুলো ভালো করে মনিটরিং না করায় এমনটা হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর উচ্ছেদকৃত তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, বনায়ন, তিনটি ইকোপার্ক, ছয়টি পন্টুন, ৪০ কিলোমিটার কি-ওয়াল, ১৯টি আরসিসি জেটি, ৪০ টি স্পার্ড ও ৪০৯টি বসার বেঞ্চ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে যা ২০২২ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ২৩৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে ঢাকার চারপাশে নদীর তীরভূমির প্রায় ১৪৫.১ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় নিলামের মাধ্যমে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা এবং জরিমানার মাধ্যমে ২৭ লাখ ৬ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কর্তৃক ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নদীর তীরের সীমানা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ৯ হাজার ৫৭৭ টি সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮৫৫টি পিলার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কিত ২ হাজার ১১৪টি পিলারের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ নদী তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৬১২.২২ একর জমি উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ঢাকার চারপাশে ৩৭৮.৬২ একর এবং নারায়ণগঞ্জে ২৩৩.৬০ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১৫ হাজার ৫৯২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১২ হাজার ৪৭৮টি এবং নারায়ণগঞ্জে ৩ হাজার ১১৪টি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
সারা দেশের অভ্যন্তরীণ নদীর নাব্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে সাতটি প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশের নদী খনন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। খাগদোন, বিষখালী, কীর্তনখোলা, যাদুকাটা, রক্তি, রকশোনালা, কর্ণপাড়াখাল, লোহালিয়া, মনু, পিয়ান, আড়িয়াল খাঁ, ইছামতি, তালতলাখাল, পালং, নড়িয়াখাল, পুরাতন দুবালদিয়া, শীতলক্ষ্যা, কালিগঙ্গা, শৈদাহ, গাঘর, মধুমতি, কাচিকাটাখাল, পাড়কোনা, তুরাগ, কুমার, ধলেশ্বরী, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, তিতাস নদী, কংস, বাউলাই, সুরমা, মগড়া, পাগলা, বুড়ি, ভোগাই-কংস, নতুনডাকাতিয়া, বাঁকখালী, ভৈরব, আত্রাই, ভোলা, পালরদি, কর্ণতলী, পদ্মা, মেঘনা, গাবখানখাল, কর্ণফুলী নদী চ্যানেল, পশুর নদী চ্যানেল, কাজল-তেঁতুলিয়া নদীতে খনন কাজ চলমান রয়েছে বলে সভায় জানানো হয়।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply