সন্তান একজন নারীকে পরিপূর্ণ করে তোলে। তবে বর্তমানে, গর্ভধারণে নানা রকম জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর একটি কারণ হল অধিকাংশ দম্পতিরই এই ব্যাপারে কোনো পূর্বপরিকল্পনা থাকে না।
সন্তান ধারণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। তাই প্রতিটি হবু মায়েরই উচিত নিজেকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সন্তান ধারণের জন্য প্রস্তুত করা। যারা নতুন মা হতে যাচ্ছেন তাদের জরুরি করণীয় বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হল।
আদর্শ ওজন অর্জন করা
গর্ভবস্থায় প্রতিটি মায়েরই ওজন বাড়ে। আর এই ওজন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া, গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ,বিকাশ, পুষ্টি এবং সর্বোপরি সুস্থ শিশু জন্মদানের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এসময় অধিকাংশ মায়েদের সর্বনিম্ন ১০ কেজি থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত ওজন বাড়তে পারে।
তাই যারা মা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারা সবার আগে নিজের উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন অর্জনের চেষ্টা করুন।
যদি কারো ওজন বেশি থাকে তবে গর্ভধারণের পূর্বেই ওজন কমানো উচিত। এর ফলে গর্ভকালীন সময়ে মা এবং শিশুর অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। কেননা, গর্ভধারণের আগে যেসব মায়ের ওজন বেশি থাকে তারা গর্ভকালীন সময়ে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিলতায় ভুগতে পারেন, যা মা এবং গর্ভস্থ শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।
একই ভাবে, যাদের ওজন কম, তাদের উচিত তাদের আদর্শ ওজন অর্জন করা। যেসব মায়ের ওজন কম তারা নিজেরাই নানা রকম অপুষ্টিতে ভোগেন যা তার অনাগত সন্তানের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং, সুস্থ শিশু জন্মদানের জন্য অবশ্যই আপনাকে আপনার ওজনের উপর নজর রাখতে হবে।
কোনো বিশেষ রোগ বা পুষ্টি উপাদানের অভাব আছে কি না সে বিষয়ে অবগত হওয়া
যারা সন্তান ধারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের উচিত অন্তত ৬ মাস আগে থেকে নিজেকে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করা। গর্ভকালীন পুরো সময়টার জন্য নিজে কতটুকু ফিট আছেন তা জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে একজন ডাক্তারের মাধ্যমে মেডিক্যাল চেকআপ করা।
দেহে আয়রন, ভিটামিন-ডি, ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন বা ভিটামিন-বি এর ঘাটতি থাকলে গর্ভধারণের পূর্বেই তা পূরণের চেষ্টা করা উচিত। কেননা গর্ভস্থ শিশুর জন্য এসব ভিটামিন বা মিনারেল ভাইটাল হিসেবে বিবেচিত।
যদি প্রতিদিনের খাদ্যের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে অবশ্যই সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে।
এছাড়া ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিস আছে কি না, হরমোনাল কোনো সমস্যা, যেমন হাইপো বা হাইপার থাইরয়েড, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম। এছাড়া, লিপিড প্রোফাইল, ইউরিক এসিড লেভেল বা ইলেট্রোলাইটস ঠিক আছে কি না জানা উচিত।
যদি এই ধরনের কোনো সমস্যা থাকে তবে তা আগেভাগে চিকিৎসা করানো উচিত। তাহলে, পুরো প্রেগনেন্সি জার্নিটা আপনার এবং আপনার গর্ভস্থ শিশু উভয়ের জন্য নিরাপদ হবে।
নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
গর্ভধারণের পূর্বেই একজন নারীকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে যেন মা এবং শিশু সঠিক পুষ্টি পায়। আর এজন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ অপরিহার্য। গর্ভধারণের অন্তত ৩-৬ মাস আগে থেকে হবু মায়েদের উচিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে নিজের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ ঠিক রাখা। গর্ভধারণের পরে যেন গর্ভস্থ শিশুর কোনো পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি না হয়।
নিয়মিত বিভিন্ন রঙের শাকসবজি, ফল, দেশি মাছ, মুরগী, ডিম, ডাল, দুধ, দই, বিভিন্ন রকমের বাদাম, বাদামি চালের ভাত সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করুন।
বাইরে খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন। বাইরের অস্বাস্থ্যকর কিন্তু মুখরোচক খাবারগুলোর আড়ালে থাকে আপনার এবং আপনার অনাগত সন্তানের জন্য নানা রকম জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকি।
বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবারগুলোয় যেসব ক্ষতিকর উপাদান থাকে তাতে আপনার মিসক্যারেজ, সন্তানের জন্মগত ত্রুটি বা অটিজম পর্যন্ত হতে পারে। আর হ্যাঁ, সঠিক পরিমাণে পানি পান করতে ভুলবেন না।
ফলিক এসিড গ্রহণ করা
গর্ভধারণের অন্তত ৩ মাস আগে থেকে ফলিক এসিড গ্রহণ করা উচিত। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফলিক এসিড অতি জরুরি একটি ভিটামিন। কেননা, এই ভিটামিনের অভাব হলে শিশুদের ব্রেন এবং মেরুদণ্ডে ত্রুটি দেখা দেয় যা নিউরাল টিউব ডিফেক্টস নামে পরিচিত।
গর্ভকালীন সময়ে ফলিক এসিডের চাহিদা বেড়ে যায়। এই বাড়তি চাহিদা যথাযথভাবে খাদ্যের মাধ্যমে পূরণ হয় না বলে ৩ মাস আগে থেকেই ফলিক এসিডের সাপ্লিমেন্ট নিতে পরামর্শ দেয়া হয়।
মনে রাখবেন, গর্ভধারণের প্রথম ২৮ দিনের মধ্যে ফলিক এসিড সবচেয়ে জরুরি কেননা এই সময়েই অধিকাংশ নিউরাল টিউব ডিফেক্টসগুলো ঘটে। তাই এসময়ে কোনোভাবেই যেন ফলিক এসিডের অভাব না হয় তাই এই বাড়তি সতর্কতা।
সবুজ শাক যেমন পালংশাক, সাইট্রাস ফল যেমন কমলা, ডিম, ব্রকলি, বাদাম ফলিক এসিডের উৎস।
ব্যায়াম করা
গর্ভকালীন কঠিন এবং জটিল সময় পাড়ি দেয়ার জন্য শারীরিকভাবে ফিট থাকার কোনো বিকল্প নেই। তাই গর্ভধারণের আগে থেকেই ব্যায়াম বা ইয়োগা করতে পারেন। এর ফলে আপনি যেমন ফিট থাকতে পারবেন তেমনি আপনার গর্ভধারণের সম্ভাবনাও বাড়বে। সুতরাং, নিয়ম করে প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা বা অন্য কোনো ব্যায়াম করুন।
হাসিখুশি থাকা
আর হ্যাঁ, গর্ভধারণের আগে থেকেই যতটা সম্ভব রাগ, ক্ষোভ, হতাশা থেকে দূরে থাকুন। নিয়মিত বই পড়ুন, অংক করুন। আপনি যা যা করতে পছন্দ করেন সেগুলো করুন। সবসময় হাসিখুশি থাকুন, সবসময় পজিটিভ চিন্তা করুন।
মনে রাখবেন, যেভাবে আপনার রাগ, ক্ষোভ, হতশা আপনার গর্ভস্থ শিশুর উপর প্রভাব ফেলে ঠিক একইভাবে আপনার হাসি-আনন্দও গর্ভস্থ শিশুর উপর প্রভাব ফেলে। সুতরাং, মন খুলে হাসুন।
লেখক : পুষ্টিবিদ, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply