বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে যাবেন এমন গুঞ্জন বেশ কয়েকদিন ধরে বাতাসে ভাসছে। সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রী-নেতারাও এবিষয়ে কথা বলেছেন। দলীয় প্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সুষ্পষ্টভাবে কিছুই বলতে পারছিলেন না বিএনপি নেতারা। অন্যদিকে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির ৬ এমপির শপথ নিয়েও দল এবং দলের বাইরে চলছে নানা গুঞ্জন। দলীয় প্রধানের নির্দেশনা না পাওয়ায় এ বিষয়েও আনুষ্ঠানিক কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি দলটি। তবে বেগম জিয়ার সাথে নেতাদের এক সাক্ষাতে সব কিছু সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। প্যারোল ও এমপিদের শপথ গ্রহণের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের জানিয়েছেন প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যের অবনতি স্বত্তে¡ও প্যারোলে মুক্তির আবেদন তিনি করবেন না। মুক্তি নিতে হলে আইনি প্রক্রিয়াতেই তিনি মুক্ত হবেন। আর যে সংসদ নির্বাচন দল প্রত্যাখ্যান করেছে সেই সংসদে শপথ না নেয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন তিনি।
কারাগারে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় গত ১ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) খালেদা জিয়াকে ভর্তি করা হয়। সেখানে কেবিন বøকের ৬২১ নম্বর কক্ষে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাকে বিএসএমএমইউতে আনার পর থেকেই প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলে খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চাইলে বিবেচনা করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও আইন মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর নড়েচড়ে বসে সবাই। তবে বিএনপি প্রধান প্যারোলে মুক্তি নিবেন কিনা সেবিষয়টি তার সাথে কথা না বলে কিছুই জানাতে পারেনি দলটির সিনিয়র নেতারা। অবশেষে গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিনে বিএসএমএমইউতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন। সেখানে তারা এক ঘণ্টা অবস্থান করেন।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনায় তার স্বাস্থ্যের সার্বিক বিষয়ে জানতে চান। তবে আলোচনার সময় সরাসরি প্যারোলের বিষয়টি কেউ তোলার সাহস না পেলেও আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়। তবে খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে প্যারোলের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি নেতাদের বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে তার প্রত্যেকটিই মিথ্যা। আদালতে সুবিচার পেলে তিনি এতদিনে সব মামলা থেকে রেহাই পেতেন। সরকার সেটা করতে দিচ্ছে না। এখন তাকে প্যারোলে মুক্তির নামে আরেক দফা নির্যাতন করতে চাইছে। বিএনপির এক নেতা জানান, খালেদা জিয়া প্যারোলের বিষয়ে ইঙ্গিত করা হচ্ছে বুঝতে পেরে নেতাদের জানিয়ে দেন তিনি কোন আবেদন করবেন না। যদি মুক্তি পেতে হয়ে তাহলে আইনি প্রক্রিয়াতেই তিনি মুক্ত হবেন। অন্য কোনভাবে নয়। শারীরিক অবস্থা প্রতিনিয়ত অবনতি হলেও তিনি সরকারের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। তিনি তার যে কোনো অবস্থার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্যারোলে মুক্তি নেয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়া কোন সিদ্ধান্ত নেননি। এ বিষয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে বা গণমাধ্যমে ছাপানো হচ্ছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আমরা দেশনেত্রীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি বেশ অসুস্থ, এখনও খেতে পারছেন না। পা বাকা করতে পারেন না। তার বাম হাত ঠিকমতো কাজ করছে না। এ অবস্থার মধ্যে তিনি আছেন। এক কথায় ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যথেষ্ট অসুস্থ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্তি চাই। তবে তিনি এখন খুবই অসুস্থ। ওনার বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন। আমরা সেই দাবিই জানাচ্ছি।
অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, বিএনপি প্রধানের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার কারণে সরকারের একটি পক্ষ বিএসএমএমইউতে তার কাছে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে প্রস্তাব দেয়। তাদেরকেও খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি প্যারোলে মুক্তি নিবেন না। এধরণের কোন আবেদনও করবেন না। হয় আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হবেন, নাহলে যে কোন অবস্থার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। সূত্রটি আরও জানায়, খালেদা জিয়া প্যারোলে রাজি না হওয়ায় একই প্রস্তাব তার পরিবারের কাছে দেয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার বক্তব্যকেই তাদের বক্তব্য বলে উল্লেখ করে।
এদিকে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ৬জন এমপি। এদের কেউ কেউ এবারই প্রথম এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ এর আগে এমপি-মন্ত্রী ছিলেন। যদিও দলটি নির্বাচনের দিনই আগের রাতে ভোট ডাকাতি হয়েছে অভিযোগ করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। পুনঃনির্বাচনের দাবিতে একাধিক কর্মসূচিও পালন করা হয় দলটির পক্ষ থেকে। ফলাফল প্রত্যাখ্যান করায় এখন পর্যন্ত শপথ নেয়নি বিএনপির প্রার্থীরা। তবে শপথ গ্রহণের সময়সীমা শেষ দিকে এসে গত কয়েকদিন ধরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে যে, বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা শপথ গ্রহণ করবেন। এমপিদের দু’একজন এলাকার মানুষের চাপের কথা উল্লেখ করে শপথের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবও ব্যক্ত করেছেন গণমাধ্যমে। এতে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই বিষয়েও খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করার পর দলের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলটির নেতারা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতের সময় শপথের বিষয়টি তোলা হয়। তখন খালেদা জিয়া এই বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তিনি নেতাদের বলেন, এ সংসদে গিয়ে লাভটা কি হবে। সংসদের বাইরেও অনেক ভূমিকা পালন করা যায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন নেতা জানান, শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে এখনো তিনি অনেক দৃঢ় রয়েছেন।
খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতে তার অবস্থান জানার পর গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ৫ এমপিকে ডেকে বৈঠক করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয় এবং বেগম জিয়া ও বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমপি হারুনুর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের ডেকেছিলেন মহাসচিব। কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকায় আমাদের শপথ গ্রহণ নিয়ে নানা খবর প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে। যাতে আমাদের কেউ বিভ্রান্ত না হন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে না যান। তিনি বলেন, আমাদের কয়েকজন আগে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন আবার কয়েকজন এবারই প্রথম নির্বাচিত হয়েছেন। যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ওপর এলাকার মানুষের চাপ আছে এটা সত্য। কেউ কেউ তাদের বক্তব্যে সেটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমরা নির্বাচিত হয়েছি দলীয় প্রতীকে, দলের সমর্থনে। এখানে দলের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান। আমরা এখন পর্যন্ত একমত যে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নেব না।
শপথ নেয়ার পক্ষে নিজের ওপর চাপ আছে বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচিত প্রার্থী জাহিদুর রহমান। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি ইনকিলাববে বলেন, আমার এলাকার ৯৯ভাগ মানুষ শপথ নেয়ার পক্ষে। আমরাও জানি সংসদে গিয়ে কিছু হবে না। কিন্তু প্রেসক্লাবের সামনে কথা বলা আর জাতীয় সংসদে কথা বলা দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। সংসদে কথা বললে ১৬ কোটি মানুষ শুনবে। দল যে সিদ্ধান্ত নেবে এখন পর্যন্ত তিনি সেটি মেনে নেয়ার পক্ষে আছেন জানিয়ে বলেন, ইতোমধ্যে বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে। গতবার নির্বাচনে যায়নি। এবার যদি শপথ না নেয়, তাহলে নির্বাচনে গিয়ে ভুল করেছে? তবে তার এলাকার নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে এ ধরণের কোন চাপ নেই। এমনকি দলের নেতাকর্মীরাও এ বিষয়ে তেমন উৎসাহ বোধ করেন না। কিন্তু জাহিদুল ইসলাম প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ায় সংসদে যেতে তার নিজেরই আগ্রহ বেশি। এলাকার মানুষের চাপের কথা বলে তিনি তার এই আগ্রহকে বৈধতা দিতে চান। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলে এলাকায় তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হবে বলেও অনেকে জানান।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা তো এ সংসদকেই নির্বাচিত বলছি না, আমরা ওই কথিত নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি। তাই শপথ গ্রহণের বিষয়টি আসে না।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply