এই যে, চওড়া পিচঢালা রাস্তা; রাস্তার দু পাশে সুন্দর চওড়া ফুটপাত। সেদিন কোনোকিছুই ঠিক এমন ছিল না। আজকের মতো নির্ভয়ে মানুষ হেঁটে যেতে পারে নি। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে নি। টি এসসি চত্বরে এত সবুজ, তরুণ প্রাণে এত উচ্ছ্বাস ছিল না। তবু কী যেন ছিলো। কী যেন একটা ছিলো সেদিন- অতুলনীয়, অসাধারণ, যেটি জাতি হিসেবে আমাদের করেছে অনন্য।
বলছিলাম ১৯৫২ সালের কথা। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির গর্ব করবার মতো যে অল্প কয়েকটি ইতিহাস রয়েছে, তাদের একটি। আচ্ছা, দিনটা কেমন ছিল তাহলে? শাহবাগের ফুলের দোকান গুলো কী ছিল? কোনো প্রেমিক তার প্রেয়সীর জন্যে ফুল কিনতে পারতো সেখান থেকে নির্ভয়ে?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ ছিলো নিশ্চয়ই অনেক। গাছে মগডালে বসে পাখিরা কী তাদের নিজস্ব ভাষায় ডাকতে পারতো? না, আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেবার অপচেষ্টায়, দুঃখে তারা করুণ স্বরে ডেকে চলতো। এই যে পিচ ঢালা পথ মাড়িয়ে শত শত, হাজার-হাজার মানুষ আজ ফুল দিতে যাবেন, এই পথটাই সেদিন রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিলো রক্তে। পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে ছিলো রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের নিথর দেহ।
শক্ত কংক্রিটের পথ সে বীরের শরীর, বীরের রক্ত আগলে ধরে ইতিহাস গড়ে রেখেছে নিজের বুকে সযত্নে। তারপর না আমরা পেলাম আমাদের ভাষা, শুধু আমাদের নিজস্ব একটি ভাষা- মাতৃভাষা। কী সহজে লেখা হয়ে গেলো, আমরা মাতৃভাষা পেলাম। ব্যাপারটা এত সহজ ছিলো না। ভাষার জন্যে আন্দোলনের বারুদ একদিনে ফুঁসে ওঠে নি। বহুদিনের ক্ষোভের ফসল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা করেন, ‘উর্দু, এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ তখন পাকিস্তান বলতে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান।
বাংলাদেশের তৎকালীন নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান, এটি তখন পাকিস্তানেরই অংশ। এর ভাষা ছিল বাংলা, সংস্কৃতি ছিল বাংলার। শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে বাংলা ভাষাভাষী বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা হবে। আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলা যাবে না। এর আগে বহু শোষন, নিপীড়ন সহ্য করলেও ভাষার উপর এই আঘাত বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা মেনে নিতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারা পরিকল্পিতভাবে নেমে আসে রাজপথে।
যুদ্ধ চলে ভাষার জন্য। যুদ্ধে হানাদারের ছিল অস্ত্র, আমাদের ছিলো একতা, মনোবল, ভাষার জন্যে, দেশের জন্যে ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ। অবশেষে ভালোবাসারই জয় হলো। অসীম মূল্যবান কিছু জীবনের মূল্যে আমরা পেলাম আমাদের মাতৃভাষা। আজ সেই একুশে ফেব্রুয়ারি। ফুলে ছেয়ে যাবে শহীদ মিনারের বেদী। শ্রদ্ধায়, সম্মানে অবনত হব আমরা।
এই সম্মান যেন শুধু একদিনে সীমাবদ্ধ হয়ে না থাকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হোক বছর জুড়ে, শুদ্ধ বাংলা ভাষাচর্চার মাধ্যমে- এটিই প্রত্যাশা।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ ও এস
Leave a Reply