জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি ও নিজেদের ভ্যানগার্ড বলে স্বীকৃত ছাত্রদলের বিরোধ নিয়ে বিএনপিতে চলছে গৃহদাহ। এ দ্বন্দ্বে ঘি ঢেলেছে জ্যেষ্ঠ নেতাদের লবিং-গ্রুপিং। সব মিলে মাঠে নেতাকর্মীদের জোরালো কোন আন্দোলন সংগ্রাম দেখা না গেলেও ভেতরে ভেতরে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই। একই সঙ্গে বড় কোন কর্মসূচি না থাকলেও কার্যালয়ের আবাসিক নেতাখ্যাত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলটির কার্যক্রমকে বিবৃতিনির্ভর করে তুলেছেন। সম্প্রতি বরগুনায় রিফাত হত্যা, ঢাকার ডেঙ্গু, সারা দেশে বন্যা, শেয়ার বাজারে ধস, গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার নালিশ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও বিএনপি নিশ্চুপ।
সম্প্রতি ঘোষণা দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তার বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক এ মোর্চায় ভাঙন স্পষ্ট হলো। তার আগে জামায়াত প্রশ্নে এ ফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামনে আসে। নানা লুকোচুরি শেষে গণফোরাম ও বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথকে ঘিরে সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
বর্তমানে বিভাগীয় পর্যায়ে বিএনপির যে কর্মসূচি চলছে তার মধ্যে সমন্বয় নেই, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে জোরালো কোন কর্মসূচিও নজরে পড়ছে না। বন্যার্তদের পাশে দলটির পক্ষে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিলেও এবার স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন নির্বাচনে যাবে প্রতীক ছাড়া। ধানের শীষ পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের যে ব্যাকুলতা, তা পরিস্থিতির কারণে এড়িয়ে যাচ্ছে দলটির নেতাকর্মীরা। অনেকটা আপস করেই কৌশল অবলম্বন করছেন তারা।
ছাত্রদল কমিটি বিলুপ্ত করার পর দুদফা তারিখ দিয়েও নতুন কমিটি গঠন করতে পারছেন না দায়িত্বশীলরা। বরং বিদ্রোহীদের বিক্ষোভে নাস্তানাবুদ। গত সোমবারও বিক্ষুব্ধ ছাত্রনেতারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। এর আগে গত ২৪ ও ২৫ জুন তারা হামলা চালিয়ে কার্যালয় ভাংচুর ও বিক্ষোভ করেন। জুনের শুরুতেই ধারাবাহিকভাবে চলা এ অসন্তোষ দফায় দফায় বৈঠক করেও সিনিয়র নেতারা সমাধান করতে পারেননি। লন্ডনের স্কাইপি বার্তাও কোন কাজে আসেনি।
২০১৪ সালের অক্টোবরে রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দুই বছর মেয়াদি ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালের অক্টোবরে। আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলেছে সংগঠনটির কার্যক্রম।
পরে নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে মার্চে সাবেক ছাত্রনেতাদের দিয়ে একটি সার্চ কমিটি করে দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি নেতাদের পছন্দের প্রার্থীদের পদে আনতে পরিস্থিতি তারাই জটিল করেছেন। আমান উল্লাহ আমান ও রুহুল কবির রিজভী নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ ছাত্রদলকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে। সেখানে লবিং-গ্রুপিং অনেকটা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এর ফলে বয়স্ক ছাত্রনেতাদের অন্যত্র পদায়ন না করে নতুন কমিটি গঠন করা বড় চ্যালেঞ্জ।
গতকাল ত্রাণ বিষয়ক কমিটির সভা শেষে ছাত্রদলের সার্চ কমিটির নেতা, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, একটি বৃহৎ দলে পদ পদবি নিয়ে টানাটানি থাকবেই। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের নির্দেশে অল্প দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
আমান উল্লাহ আমান লবিং গ্রুপিং এর কথা অস্বীকার করে বলেন, ছাত্রদলের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মিরা এখন মামলা হামলায় জর্জরিত। বিগত দিনে দলের জন্য যারা নিবেদিত ছিল আগামী দিনে তাদের মূল্যায়নটা নিশ্চিত করার জন্যই সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগছে। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই।
অন্যদিকে গত সোমবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভ শেষে কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবির বলেন, যদি দল প্রয়োজন মনে করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটি নির্দিষ্ট বয়সের ছাত্রদের নিয়ে আসবে তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু যারা বাদ যাবেন তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। আমাদের দাবি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, কৃষক দলের নেতৃত্ব নির্ধারণেও একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমায় এনে আমাদের পুনর্বাসন করা হোক।
আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে না পাওয়া গেলেও পদ-পদবীর ভাগবাটোয়ারাতে এ দলটির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা সব সময় দেখা গেছে। গত নির্বাচনে সব রকমের অনিশ্চয়তা সত্বেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ধানের শীষ বিক্রি হয়েছে বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ উঠেছে। দলের ত্যাগি নেতাকর্মী ও শরিকদের মধ্যেও এ নিয়ে কথা চালাচালি হয়েছে।
বিএনপি মাঠে ময়দানে না থাকলেও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আগুন সন্ত্রাস ও জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রতিদিন বিএনপিকে সামনে টেনে আনতেন। সম্প্রতি বর্তমান তথ্যমন্ত্রীও নানা প্রসঙ্গে বিএনপিকে আলোচনায় আনছেন। গতকাল তিনি সচিবালয়ে নিজ দফতরে ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, বন্যার্ত মানুষের জন্য বিএনপি ও গণফোরামের তৎপরতা প্রেস ক্লাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের আন্দোলন সংগ্রামও প্রেসক্লাবেই আটকে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক মানিকগঞ্জে ত্রাণ দিতে বলেছেন, বন্যার্তদের নিয়ে বিএনপি অপরাজনীতি করছে। গত সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ত্রাণ বিতরণে গিয়ে বলেন, গণপিটুনি ও ধর্ষণ বিএনপি জামায়াতের নিখুঁত ষড়যন্ত্র। একই দিনে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, বিএনপি দেশজুড়ে নানা নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র করছে। বন্যার্তদের নিয়েও তারা রাজনীতি করছে বলে তিনি একটি অনুষ্ঠানে জানান।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply