বাঙালি বাড়িতে কাঁচা পেঁপের কদর আছে। আগে বাঙালির পেট-রোগা বলে একটা বদনাম ছিল-এখন হয়তো স্বাস্থ্য-সচেতন হয়ে ওঠার জন্যে সেটা অনেকটা কমেছে। কিন্তু পেটের অসুখে কাঁচকলা ও কাঁচা পেঁপের ঝোল এখন ও পথ্য। পাকা পেঁপে যেমন ফল হিসেবে প্রিয় তেমনই কাঁচা পেঁপে দিয়ে রান্না করা হয় নানারকম পদ।
শুক্তো, ডালনা, ছেঁচকি, ঘন্ট, ঝোল এসব তো আছেই আম-আদা দিয়ে কাঁচা পেঁপের চাটনি বাঙালি-রসনার চিরপ্রিয়। ভোজ বাড়িতে কাঁচা পেঁপে প্লাস্টিকের মতো স্বচ্ছ ও পাতলা করে কেটে তৈরি করা হয় ও পাতিলেবুর রস দিয়ে কুরে নিয়ে ঘিয়ে ভেজে সেদ্ধ করে চিনি ও এলাচের গুঁড়ো ও ক্ষীর দিয়ে তৈরি করা হয় পেঁপের হালুয়া। দুধে সেদ্ধ করে চিনি দিয়ে তৈরি করা হয় পায়েস, টক দই মিশিয়ে তৈরি করা হয় রায়তা, বেসন মিশিয়ে গোলোকের আকারে তৈরি করে তেলে ভেজে তৈরি করা হয় কোফতা। এই ভাবে নিরীহ-আটপৌরে, সস্তা, বারোমাস সুলভ তরকারি কাঁচা পেঁপে রসনায় হয়ে ওঠে অপরূপ।
কাঁচা পেঁপের আঠার (দুধের) আছে অনেক গুণ, পেঁপের পাতারও আছে অনেক উপকারিতা। পেঁপের আঠা বা দুধ দিয়ে মাংস রান্না করলে মাংস তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। কাঁচা পেঁপের আঠা দুধ না পাওয়া গেলে কাঁচা পেঁপে বেটে মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেও মাংস সেদ্ধ হয় তাড়াতাড়ি। শুধু যে মাংস তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয় তািই নয় মাংস হজমও হয় তাড়াতাড়ি। পেঁপে ভাতে নিয়মিত খেলেও তা তাড়াতাড়ি হজম হয় এবং পেঁপে ভাতে অন্য খাবারও তাড়াতাড়ি হজম করাতে সাহায্য করে।
নানান অসুখ সারাতে কাঁচা পেঁপের ব্যবহার:
১। প্রতিদিন দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এবং রাত্তিরে ভাত বা রুটি খাওয়ার পর এক টুকরো কাঁচা পেঁপে ভাল করে চিবিয়ে খেলে এবং তারপরে এক গ্লাস জল খেলে সকালে পেট পারষ্কার হয়-অম্বল ও বদহজমের কষ্ট দূর হয়।
২। ১০ ফোঁটা করে কাঁচা পেঁপের দুধ বা আঠা প্রতিদিন অল্প জলে মিশিয়ে খেলে দাদ ও চর্মরোগ সারে, কৃমি নাশ হয়।
৩। ২০/৩০ ফোঁটা কাঁচা পেঁপের আঠা অল্প চিনির সঙ্গে মিশিয়ে কিছুদিন নিয়ম করে খেলে পিলে (প্লীহা) রোগ সারে ও পেটের ভিতরে টিউমার এবং বায়ু গোলকের রোগে খুব উপকার পাওয়া যায়।
৪। দুই চা চামচ কাঁচা পেঁপের আঠা ২ চা চামচ চিনি মিশিয়ে কিছুদিন ধরে দিনে তিনবার করে খেলে পিলের আয়তন ক্রমশ কমে যায়।
৫। কাঁচা পেঁপে মোটা করে ছাড়িয়ে সেই ছালের ছোট ছোট টুকরো ভিনিগারে ডুবিয়ে কাচের বোয়ামে রেখে আচার তৈরি করতে হবে। এই খোসার ৭/৮ টুকরো দিনে ২ বার করে খেলে অনেক সময় পিলের রোগ একেবারে সেরে যায়।
৬। কাঁচা পেঁপের খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ভিনিগারে ডুবিয়ে কাচের বোয়ামে ভরে রোদ্দুরে রেখে প্রথমে আচার তৈরি করতে হবে। এই আচার তিন-চার টুকরো করে প্রতিদিন দু-বার করে খেলে অনেক সময় কঠিন প্লীহা রোগ পিলের অসুখ সারে।
৭। দুই চা চামচ পেঁপের আঠার ১ চা চামচ চিনি মিশিয়ে দুধের সঙ্গে খেলে অম্ল (অম্বল) ও অজীর্ণ রোগে উপকার হয়।
৮। পেঁপে শুকিয়ে গুঁড়ো করে অল্প নুন মিশিয়ে খেলে দুরারোগ্য পিলের অসুখ সারে- এই ওষুধ পুরোনো পেটের অসুখেও উপকারী।
৯। কাঁচা পেঁপের তরকারি অর্শ ও পিলের অসুখে আরাম দেয় এবং লিভার (যকৃৎ) বৃদ্ধি রোধ করে।
১০। যে সব মায়েদের সদ্য বাচ্চা হয়েছে কাঁচা পেঁপের তরকারি নিয়মিত খেলে তাঁদের স্তনের দুধ বাড়বে।
১১। কাঁচা পেঁপে বা পেঁপের গাছের আঠা পুরোনো অজীর্ণ রোগে, পেটের অসুখ অতিসর পুরনো পেটের অসুখ কোষ্ঠবদ্ধতা মল না হওয়া প্রভুতি রোগের পক্ষে বিশেষ উপকারী।
১২। পিলে ও লিভার বেড়ে যাওযা, তার সঙ্গে জ্বর ও দুর্বলতার ওষুধ হিসেবে দিনে ও বাত্তিরে খাওয়া দা্ওয়ার পর নিয়মিত ৫/১০ ফোঁটা করে পেঁপের আঠা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
১৩। ওষুধ হিসেবে কাঁচা পেঁপের গুণ পাকা পেঁপের চেয়ে বেশি পেপটিন বা পেঁপের আঠার গুণ অশেষ।
১৪। গর্ভবতী মহিলাদের এবং যাঁদের মাসিক বেশি হয়। তাঁদের পেঁপে খাওয়া উচিত নয়-কারণ পেঁপে রজঃ
(রক্ত) ও ভ্রূণ নিঃসারক।
১৫। বড় কাঁচা পেঁপে চিরে নিয়ে তার নীচে একটি চীনামাটির কাপ বা ডিশ রাখুন। এইভাবে দুধ বের করে নিন। এই দুধ বা আঠা তৎক্ষণাৎ রোদ্দুরে শুকিয়ে নিন। এই আঠা গুঁড়ো করে শিশিতে ভরে ঢাকনা বন্ধ করে রাখুন। গ্যাস্ট্রিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের অসুখে এই চূর্ণ ব্যবহার করলে আশ্চর্য ভাল ফল পাওয়া যায়। পাকস্থলীর দাহ, বায়ু গোলক, ব্রণ, অম্লপিত্ত, বদহজম প্রভৃতি অসুখও এই চূর্ণ নিয়মিত খেলে সেরে যায়।
১৬। পেঁপের তরকারি নিয়মিত খেলে যাঁরা পেটের পীড়া বা উদররোগে ভুগছেন এবং যাঁরা হৃৎরোগে ভুগছেন তাঁদের খুব উপকার হয়।
১৭। প্রতিদিন সকালে শৌচাদি কর্মের পর মল ত্যাগ করবার পর কাঁচা পেঁপে সূঁচ দিয়ে বিধে তার রস সংগ্রহ করুন। পরিমাণ ১০/১৫ ফোঁটা তাতে সামান্য চিনি মিশিয়ে খান – বাজারের চলতি ওষুধের চেয়ে হৃদরোগে হার্টের অসুখে এই পেপটিন বেশি উপকার দেবে।
১৮। কাঁচা পেঁপের আঠা লাগালে চর্মরোগ সারে প্রথমে খুব জ্বালা করবে।
১৯। কাঁচা পেঁপের আঠা বা দুধের আর একটি গুণ হল হজম সম্পর্কিত যে কোনো অসুখেই এটি কাজ দেয় অত্যন্ত পাচক হজম করায়, বেদনা নাশক, কুষ্ঠরোগ নাশক, কৃমি নাশ করে।
২০। আধ চা চামচ পেঁপের দুধ চিনি মিশিয়ে খেলে অজীর্ণতা সারে।
২১। কুরুনি দিয়ে কুরে নিয়ে, পাতিলেবুর রস ও নুন মিশিয়ে স্যালাড করে খেলে বা তরকারি রান্না করে খেলে অজীর্ণতায় এবং পাচন সম্বন্ধী সব অসুখে আশ্চর্য উপকার পাওয়া যায়। যাঁদের হজম ঠিক মতো হয় না তাঁদের কাছে কাঁচা পেঁপে বিধাতার আশীর্বাদ স্বরূপ।
২২। কাঁচা পেঁপের বীজ কৃমি নাশক।
২৩। এই বীজ খেলে মেয়েদের ঋতু নিয়মিত হয় এবং বেশি পরিমানে খেলে গর্ভপাত হয়।
২৪। পেঁপের পাতা খেলে বুক ধড়ফড়ানো কমে, নাড়ির গতি স্বাভাবিক হয়। হার্টের আরাম হয়। ঘাম দিয়ে শরীরের গ্লানি বেরিয়ে যায়। মূত্রের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে শরীর সুস্থ হয়।
২৫। পেঁপের পাতা হার্ট সবল করে এবং জ্বর নাশ করে।
২৬। কাঁচা পেঁপের রস বা দুধ খেলে অরুচি, অনিদ্রা মাথা ব্যথা ইত্যাদি অজীর্ণতা সম্পর্কিত সব অসুখেরই উপশম হয়।
২৭। পেটের সঞ্চিত আম আমাশা বিনাশ করবার অদ্ভূত শক্তি আছে কাঁচা পেঁপের আঠার। শিশুদের চেয়ে বড়দের অজীর্ণতায় কাঁচা পেঁপে বেশি উপকারী।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply