ঈদে মিলাদুন্নবী পরিচিতি:
ক.শাব্দিক পরিচয়
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ শব্দটি যৌগিক শব্দ। যা তিনটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এক, ঈদ দুই, মিলাদ তিন, নবী।
প্রথমত: ঈদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ উৎসব, আনন্দ, খুশি।
বিশ্ববিখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনু মনযুর বলেন- العيد كل يوم فيه جمع অর্থাৎ ‘সমবেত হবার প্রত্যেকদিনকে ঈদ’ বলা হয়।
মুফতি আমীমূল ইহসান আলাইহির রাহমাহ বলেন-العيد كل يوم فيه جمع او تذكار لذي فضل অর্থাৎ কোন মর্যদাবান ব্যক্তিকে স্মরণের দিন বা সমবেত হবার দিনকে ঈদের দিন বলা হয়।
দ্বিতীয়ত: মিলাদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ: জন্মকাল, জন্মদিন। এ অর্থে মাওলিদ (مولد) শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় অত্যোধিক।
তৃতীয়ত: নবী, এখানে নবী বলতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। কারণ মুসলিম জাতি ও পুরো সৃষ্টিজগত তাঁর আগমণের শোকরিয়া আদায় করে।
সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ অর্থ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগমনের আনন্দ উৎসব।
খ.‘মিলাদুন্নবী’ শব্দের প্রচলন
‘মিলাদুন্নবী’ শব্দের মধ্যে ‘মিলাদ’ শব্দটি কারো জন্ম বা জন্মকাল বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এ অর্থে শব্দটির ব্যবহার রয়েছে হাদিস শরিফে, অভিধান গ্রন্থে, ইতিহাস গ্রন্থে, এমনকি অনেক কিতাবের নামেও। এটি নতুন কোন শব্দ নয়। এর কয়েকটি ব্যবহার নিম্নে উল্লেখ করা হল।
১.অভিধান গ্রন্থ
আল্লামা ইবনু মনযুর তার সুপ্রসিদ্ধ আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরব’- এ লিখেছেন- ميلاد الرجل : اسم الوقت الذي ولد فيه অর্থাৎ- ‘লোকটির মিলাদ- যে সময়ে সে জন্ম গ্রহণ করেছে সে সময়ের নাম।
২.হাদিস গ্রন্থ
ইমাম তিরমিযী আলাইহির রাহমাহ তাঁর ‘আল জামেউস সহীহ’ গ্রন্থের একটি শিরোনাম হল- باب ما جاء في ميلاد النبي অর্থাৎ- ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্ম সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়ের অধ্যায়।’
হযরত উসমান বিন আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বনী ইয়ামর বিন লাইসের ভাই কুরাছ বিন উশাইমকে জিজ্ঞেস করলেন-
أانت أكبر أم رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: رسول الله أكبر مني وأنا اقدم منه في الميلاد
অর্থাৎ- ‘আপনি বড় নাকি রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার চেয়ে বড়। আর আমি জন্মের মধ্যে তার চেয়ে অগ্রজ।’
৩. ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের সময় ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নেন। এদিকে মক্কার কুরাইশরা তাকে খুঁজতে খুঁজতে ‘সাওর’ গুহা মুখে পৌছলে তাদের একজন বলল-
أن عليه العنكبوت قبل ميلاد النبي صلى الله عليه وسلم فانصرفوا
অর্থাৎ- ‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের পূর্ব থেকে এ গুহামুখে মাকড়শার জাল রয়েছে। অতঃপর তারা চলে গেল।’
ইবনু আউন (রহ.) বলেন-
قتل عمار وهو إبن احدى وتسعين سنة وكان اقدم في الميلاد من رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থ- ‘হযরত আম্মার বিন ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৯১ বছর বয়সে শহীদ হন। তিনি জন্মের সুত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অগ্রজ ছিলেন।’
হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
وكان بين ميلاد عيسى والنبي عليه الصلاة والسلام خمس مائة سنة وتسع وستون سنة
অর্থাৎ- ‘আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের মাঝখানে ৫৬৯ বছর ব্যবধান ছিল।’
আল্লামা ইবনু হাজর আসক্বালানী আলাইহির রাহমাহ বলেন- فانه ولد بعد ميلاد النبي صلى الله عليه وسلم بمدة অর্থাৎ- ‘তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্মের কিছুকাল পরে জন্ম গ্রহণ করেছেন।
উপরিউক্ত উদ্ধৃতি থেকে বুঝা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্ম বুঝানোর জন্য ‘মিলাদুনবী’ শব্দটির ব্যবহার সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে অদ্যাবধি রয়েছে; এ যুগের নবসৃষ্ট কোন শব্দ নয়। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে যে ‘মিলাদুন্নবী’ একটি ইদানিং সময়ের শব্দ, যা আদৌ সঠিক নয়। আবার কেউ কেউ ‘মিলাদ’ শব্দের অর্থ ‘জন্ম’ না নিয়ে অন্য অর্থ নেয়ার চেষ্টা করে, যা কোন অভিধান প্রণেতা উল্লেখ করেননি।
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার শুভাগমনের দিন কেবল মুসলমান নয় সৃষ্টিজগতের সকলের জন্য আনন্দের ও রহমতের। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন- আমি আপনাকে জগতসমূহের রহমত করে প্রেরণ করেছি। তাই সৃষ্টির সূচনা কাল থেকে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামা উদযাপিত হয়ে আসছে। যেহেতু ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলো মুসলিম জাতির আনন্দের দিন, সেহেতু সারা বিশ্বের মুসলিমগণ অত্যন্ত ভক্তি ও মর্যাদার সাথে রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু এক দল লোক এটিকে অবৈধ ও বিদয়াতে সাইয়্যিআহ (মন্দ বিদআত) বলে প্রচার করছে। অথচ এটি একটি শরিয়ত সম্মত পুণ্যময় আমল, যা কুরআন, সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।
Leave a Reply