গ্যাংস্টার। গাল-গপ্পোভরা কোনও সিনেমার নাম নয়। তবে কাজ-কারবার অনেকটাই সিনেমার আদলে। ফ্রি স্টাইলিশ। এই বাহিনীর আতঙ্কে তটস্থ থাকেন সাধারণ মানুষ। শহর-গ্রামাঞ্চলের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকাতে এই গ্যাংস্টার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের অস্তিত্ব রয়েছে আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর নথিতে। চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডে জড়াচ্ছে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোরদের গ্যাংস্টার বাহিনী।
বরগুনায় রিফাত হত্যা, রাজধানীর উত্তরায় আদনান হত্যাসহ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি হত্যায় মিলেছে ‘গ্যাংস্টার জুনিয়র বাহিনী’র সম্পৃক্ততা। তাদের অপরাধ এতটাই ভয়ঙ্কর, নাম শুনলে অনেকেই ভড়কে যান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের দমনে হিমশিম খান।
অপরাধ বিশ্লেষকদের অভিমত, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের অভাবে অল্প বয়স থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন কিশোররা। পরিবার থেকে অনুশাসনের মধ্য দিয়ে তাদের গড়ে তুলতে না পারলে থামানো যাবে না দলবদ্ধ কিশোর অপরাধীদের। সহজেই নানা প্রলোভনে ফাঁদে পড়ে কিশোররা অতি উৎসাহি হয়ে জড়িয়ে পড়ছেন এমন এমন সব অপরাধে, যা সুস্থ মস্তিকে কল্পনাও করা যায় না। এখনই তাদের রাশ টেনে ধরতে না পারলে আগামী প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পাশাপাশি পঙ্গু করে দেবে দেশের কোমলমতি মেধাবী তরুণদের ভবিষ্যত।
এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠা এই কিশোর গ্যাংস্টাররা অবলীলায় সংঘটিত করে করে যাচ্ছে নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ড। আর তাদের পেছনে রয়েছে কোন না কোন গড়ফাদারের আর্শিবাদ বা ছত্রছায়ায়। তাদের আশ্রয়-প্রচ্ছয়ে গড়ে উঠছে নিজেদের এক একটা সাম্রাজ্য। যাদের কাজটা হচ্ছে অপকর্ম করে মানুষকে অশান্তিতে রাখা। আবার এই সাম্রাজ্য রক্ষায় মাঝেমধ্যে তারাই জড়িয়ে পড়ছেন সংঘাত ও নৈরাজ্যের পথে। যার শেষ পরিণতি অস্ত্রবাজি থেকে রক্তারক্তি ঘটনা।
জানা গেছে, মনু গ্রুপের লিডার মনির ওরফে মনু। এই কিশোর গ্যাংস্টার বাহিনী উত্তরায় জমজম টাওয়ারে স্বর্ণের দোকানে হামলা করে। অস্ত্র হিসেবে এসব কিশোর ব্যবহার করেছিল ছোট ছুরি বা চাকু। এই অস্ত্রের আরেক নাম ‘ড্যাগার’। ৯০ দশকে এই অস্ত্রের ব্যবহারটা বেশি। মাঝে বহু বছর বন্ধ ছিল। সেটা আবার দেখা দিয়েছে সমাজে। কিশোররা এসব অস্ত্র ব্যবহার করে প্রকাশ্যে মারামারিসহ ঘটাচ্ছে হত্যার মতো ঘটনা।
হাজারীবাগে খুন হওয়া লাভ লেন গ্রুপের সদস্য ইয়াসিন। এই হত্যায় জড়িত বাংলা গ্রুপের ১০ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ।
গেলো জানুয়ারিতে দক্ষিণখানে কেকড়া গ্রুপের সদস্যদের হাতে খুন হয় প্রতিপক্ষের মেহেদি।
তবে গত বছর উত্তরায় আদনান হত্যার পর আলোচনায় আসে ‘কিশোর গ্যাংস্টার বাহিনী’র কর্মকাণ্ডগুলো। তখনই টনক নড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।
তথ্যমতে জানা গেছে, টিনএজারদের গ্যাংগুলো তিন থেকে চার ধাপে বিস্তৃত। ফেসবুককেন্দ্রিক সক্রিয় হয়ে উঠা কিশোরদের এই গ্যাং-কালচারে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্মবিত্ত সকল শ্রেণির বহু কিশোরই গ্যাংস্টার থেকে হয়ে উঠছে মাফিয়া রূপে।
জিইউ স্টার গ্রুপ, এসবি গ্রুপ, ফাইভ স্টার গ্রুপ, নাইন স্টার নানা রকমের গ্রুপ রয়েছে। মূলত উচ্চ ও নিম্নবিত্তের ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যেই গ্যাংস্টার বাহিনী গড়ে তোলার প্রবণতা বেশি। এমনটাই তথ্য পাওয়া গেছে নানা পর্যবেক্ষণ করে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, কিশোরদের এই প্রবণতা থেকে বের করে না আনতে পারলে ভবিষ্যতে উদ্ভব হতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতি, যা পরবর্তীতে সামাল দিতে বড় ধরনের মাশুল গুণতে হবে সমাজকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক আইজি বলেন, ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যার পর আলোচনায় আসে বিভিন্ন তরুণ গ্যাংস্টারের বিষয়টি। তবে দেশে তরুণদের নিয়ে গড়ে উঠা গ্যাংস্টারের সংখ্যা কত তার কোনও হিসেব নেই। তারপরও বলবো, আমার-আপনার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে চলাফেরা করছে, তারা কি করছে- তার নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে।
হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নানা রকম মাদক। তাই এ সকল তরুণদের মাদকের আসক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন গডাদাররা। এটাও একটা বড় অপরাধীদের আরেক কৌশল। কিশোরদের অপরাধে জড়িত করে নিজের কার্য হাসিল করা।
সাম্প্রতিক এক ঘটনায় উঠে আসে চাঞ্চলকর তথ্য- একটি গাড়ি ছিনতাই করতে পারলে ১০০০ ইয়াবা পুরস্কার। সেই পুরস্কারের লোভে গাড়ি ছিনতাই করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এক গ্যাং সদস্য।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে এই তরুণ গ্যাংস্টারদের মূল উৎপত্তি হচ্ছে বলে মনে করেন আইন-শৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞরা।
ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান দৈনিক জাগরণকে বলেন, দেশের তরুণরা পেটের ভেতরে করে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে আছে ইয়াবা। মাদকের কারণে কিশোররা প্রকাশ্যে কিংবা রাতের আঁধারে গলা কেটে হত্যা করছে নিরীহ পথচারীকে। আবার বিকৃত ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে অন্যকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না এই কিশোর অপরাধীরা। তাদের রুখতে নেয়া হচ্ছে নানা রকম তৎপরতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা খানম মনে করেন, গ্যাং-কালচার মূলত মাদক, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক সংস্পর্শে প্রসার লাভ করে থাকে। কেন-না আমাদের চলমান সিস্টেমটা সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় এই সকল অপরাধ পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং বেড়েই চলছে।
অপরাধ বিশ্লেষক জিয়া রহমান বলেন, যে কোনও পরিবর্তনের ধারক বাহক হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এই সঙ্কট যদি এখনই কাটাতে না পারা যায়, পরে আরও বেশি সংঘবদ্ধ ও ভয়ঙ্কর হবে। ছোট থেকে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাবে তরুণ প্রজন্ম। এর প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে একটি পলিসি থাকতে হবে। স্কুল পর্যায়ে ‘সাইকোলজিস্ট’ রাখা জরুরি। তাতে করে কিশোরদের মন বিক্ষিপ্ত হবে না। অপরাধ থেকে দূরে থাকবে মন ও মানসিকতা।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply