মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সবচেয়ে সার্বজনীন অভিব্যক্তি হলো ‘হাসি’। এটি হচ্ছে এমন এক উপায় যা দিয়ে মানুষ বড় সামাজিক গণ্ডি প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে পারে। তবে হাসিখুশি থাকলেই যে সেই ব্যক্তি সুখী হবেন, এমনটা নাও হতে পারে। বহু যুগ ধরে প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে, হাসি সবচেয়ে সেরা ওষুধ। বিষয়টি এখন বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক নৃতত্ব বিষয়ক ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক বলেছেন, শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা প্রশমনে সহায়তা করে হাসি।
আসলে অট্ট হাসির সুফল সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজাই ছিল ওই গবেষণার উদ্দেশ্য। গবেষকরা ব্যথা উপশমে হাসির ভূমিকা নির্ধারণে দুটি দল তৈরি করেন। একটি দলকে কৃত্রিম ব্যথা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় এবং একইসঙ্গে হাসির ভিডিও দেখানো হয়। অন্য একটি দলকে একইভাবে ব্যথা প্রদান এবং কিছু বিরক্তিকর ভিডিও দেখার সুযোগ দেওয়া হয়।
এই গবেষণায় বেশ চমকপ্রদ ফলাফল দেখতে পান গবেষকরা। যে দলটি হাসির ভিডিও দেখছিল, তারা শুধুমাত্র হাসাহাসি করেই কমপক্ষে ১০ শতাংশ ব্যথা প্রতিরোধে সক্ষম হয়। হাসির ধরনের উপরও অবশ্য ব্যথা উপশমের বিষয়টি নির্ভর করে। এই বিষয়ে গবেষকরা জানান, অট্টহাসি ব্যথা উপশমে সহায়তা করে। অন্যদিকে, ভদ্র চাপা হাসি নমনীয়তার প্রতীক হলেও ব্যথা উপশমে তেমন একটা সহায়ক নয়।
এক্ষেত্রে গবেষকরা হাসির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে-
চোখের ভেতরেই কিছু একটা আছে
সারা বিশ্বে হাসির জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস। তার বিস্তৃত হাসি অনেক সময়ই সত্য বলে মনে হয়। গবেষকরা বলছেন, হাসি দুই ধরনের। এদের মধ্যে একটি ধরণ হলো জোর করে হাসা এবং অন্যটি হলো সত্যি সত্যি হাসি। মিথ্যের আড়ালে সত্য হাসি খুঁজে পেতে হলে চোখের কোণে ভালো করে খেয়াল রাখুন। তথাকথিত হাসির রেখা যদি আপনার সঙ্গে হেসে না ওঠে তাহলে এটা সত্য হাসি বলে ধরে নেওয়া হয়।
হাসির আড়ালে
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, আমাদের সমসাময়িক সমাজে পুরুষের তুলনায় নারীদের হাসির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। তবে আগের শতাব্দীগুলোতে পোর্ট্রেইটে নারীর হাসি প্রায় বিরল ছিল। দুনিয়াতে এখন পর্যন্ত মোনালিসার হাসি নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে। চুপচাপ রহস্যমাখা চাহনিতে কী যে ভাবছেন তা বোঝা মুশকিল, অথচ ঠোঁটে তার আবেশ জড়ানো হাসি! এটা কি খুব পরিচিত কোনো হাসি? নাকি কোনো প্রলোভন?
হাসির বিপ্লব
ঐতিহাসিক পোর্ট্রেইটে মানুষ কেন হাসে না? ইতিহাসবিদ কলিন জোনস তাঁর ‘দ্য স্মাইল রেভোলিউশন ইন এইটিন্থ সেঞ্চুরি প্যারিস’ বইয়ে তিনি যুক্তি দেন যে, হাসির অর্থ একেকটা সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। ফরাসি বিপ্লবের আগে, বেশিরভাগ হাসি কৃপণতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতো। তবে বিপ্লবের মাঝামাঝি সময় থেকে একে সাম্যবাদী সমাজের চিহ্ন হিসেবে ধরা হতো।
কূটনৈতিক হাসির চেয়েও বেশি কিছু
জোনস এর যুক্তি মতে, হাসির অর্থ সময় ও জায়গার ওপর নির্ভর করে। একইসঙ্গে কোন মুহূর্তে সমাজ কখন কী গ্রহণ করে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। পথচারীর অস্থির মেজাজ কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে একটু হাসি অনেক সমাজেই বেশ পরিচিত হলেও জার্মানিতে নয়। তার অর্থ এমন নয় যে তাঁরা হাসেন না।
লুকানো উদ্দেশ্য
জার্মানির সবচেয়ে অদ্ভুত স্বভাবের শাসকদের মধ্যে বাভারিয়ার দ্বিতীয় রাজা লুডভিক অন্যতম। তাঁকে কখনোই পোট্রেইটে হাসতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ বলেন, মিষ্টি খাবারের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা আর ১৯ শতকে দাঁতের যথাযথ যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা না থাকার কারণেই তিনি এমন ভেংচি কেটে হাসতেন। আবার অনেকে এটাও বিশ্বাস করেন যে, যেহেতু তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন তাই তাঁর এই হাসির আড়ালে আসলে আর কোনো সত্য লুকিয়ে নেই।
সমগ্র বিশ্বের হাসা হাসি
‘তুমি যখন হাসো, তোমার সঙ্গে সঙ্গে সারা দুনিয়াও হেসে ওঠে’ জ্যাজ সম্রাট লুইস আর্মস্ট্রং ক্রুনস যখন এই কথা বলেন, তখন আর না হেসে থাকাটা কঠিন। এক সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁকা হাসি দেওয়াটা অনেকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল অর্থাৎ সুখী ভাব করে হাসিতেই সহজাত তারা।
হাসি থেকেই শান্তির শুরু
কলকাতায় নিপীড়িত মানুষদের নিয়ে কাজের জন্য মাদার টেরেসা ভালো কাজের প্রতীকী চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, এটা খুব সাধারণভাবেই শুরু হতে পারে। শান্তির শুরু তো হাসি দিয়ে। বিশেষজ্ঞরাও বলেন, হাসি দুই জন মানুষের সম্পর্কের মেজাজ বদলে দেয়। টেরেসা বলতেন, যখন কারও দিকে তাকিয়ে হাসো, তখন প্রত্যেকবার তার জন্য ভালবাসা তৈরি হয়, এটি তাঁর জন্য এক ধরনের উপহার হিসেবে ধরা হয়, এটি একটি অপূর্ব জিনিস।
নীরবে সহ্য করা
নারীদের দেখলে অনেকেই অযাচিতভাবে বলে বসেন, মেয়েদের হাসা উচিত। এ ধরণের অবাঞ্ছিত উপদেশ তাদের জন্য অপমানজনক এই যুক্তিতে এক সময় তারা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। কারণ, অচেনা কারও পক্ষে তো আর চেহারা দেখেই কারও কষ্টের কারণ জানা সম্ভব নয়। সুপারস্টার মেরিলিন মনরোর পরামর্শ ছিল, জীবন সুন্দর, হাসারও অনেক কিছু আছে। তাই হাসুন।
হাসি কি সংক্রামক?
শ্বাস-প্রশ্বাসের অনেক ধরনের ব্যায়াম ছাড়াও কঠিন সময়ে মনোযোগ ধরে রাখতে যোগব্যায়াম কাজে লাগে। হাসির যোগব্যায়ামে দল ধরে সবাই একসঙ্গে হাসে। অনেকে বলেন, হাসি সংক্রামক। একবার হাসি শুরু হলে সবারই মেজাজ হালকা হয়।
Leave a Reply