ফৌজদারি মামলার একটা বড় অংশের কায্যক্রম শুরু হয় থানায় এজাহার দায়েরের মধ্য দিয়ে। অপরাধ সংঘঠনের পর বিচার প্রার্থী প্রথম কাজ হলো থানায় মামলা দায়ের করা। আমলযোগ্য অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পর কোন নাগরিক থানায় মামলা করতে চাইলে পুলিশ মামলা রেকর্ড করতে অস্বীকার করতে পারেন না।
পিআরবি এর ২৪৪(ক) নিয়ম মতে, মিথ্যা বা সত্য হউক, মারাত্ত্বক বা নগণ্য হউক, পেনাল কোড বা যেকোন বিশেষ আইন বা স্থানীয় আইন সম্পর্কিত হউক, পুলিশের নিকট প্রদত্ত প্রত্যেকটি আমলযোগ্য অপরাধ সম্পর্কিত এজাহার পাওয়ার পর ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারার বিধান অনুযায়ী থানার অফিসার ইনচার্জ মামলা নিতে বাধ্য।
এরপর মামলা তদন্তের মাধ্যমে শুরু হয় বিচার কাজ। কিন্তু আইনগত বিধি নিষেধের কারণে অনেক সময় পুলিশ মামলা নিতে অনাগ্রহ দেখাতে পারে। মামলা হিসেবে রেকর্ড করার কথা আইনে বলা হলেও সব মামলার তদন্ত নাও হতে পারে। কারণ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৭ (১) (গ) ধারায় বলা হয়েছে যে, অফিসার ইনচার্জ এর নিকট যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, মামলাটির পযাপ্ত ভিত্তি নেই, তাহলে তিনি মামলাটির তদন্ত করবেন না।
আবার পেনাল কোডের ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের পাল্টা ব্যবস্থা রাখার ফলে থানায় মামলা রেকর্ড করার সুবিধাটিকে cheque and balance করা হয়েছে। সেই সুযোগটি থানা পুলিশ গ্রহন করে।পুলিশ মামলা নিতে না চাই আপনি ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়েছেন ভাবার কোন কারন নেই। কোন কারনে যদি থানায় মামলা না নিতে চায় সে ক্ষেত্রে সংক্ষুদ্ধ নাগরিক হিসাবে আপনার করনীয় বিষয়গুলি তুলে ধরা হলো।
পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করাঃ
থানায় কখনো মামলা নিতে না চাইলে বিচলিত হয়ে নিজেকে অসহায় ভাবার কোনো কারণ নেই। থানায় মামলা না নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য থানায় কমপক্ষে দুইজন ব্যক্তি সহ যাওয়া উচিত এবং থানায় প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় উল্লেখ সহ কর্তব্যরত সেন্টি ও ডিউটি অফিসারের নাম ভালভাবে জানতে হবে এবং ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৪২ ধারা অনুসরণ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী যে কেউই এ রকম পরিস্থিতিতে সরাসরি সার্কেল এএসপি কিংবা পুলিশ সুপারের নিকট গিয়ে মামলা করার জন্য আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। কোনো কারণে থানা পুলিশ যদি কখনো মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট সার্কেল এএসপি কিংবা পুলিশ সুপারের সাথে সরাসরি দেখা করে লিখিত দরখাস্তের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করার জন্য অভিযোগ দায়ের করা যায়।
সার্কেল এএসপি কিংবা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করতে চাইলে ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বলে ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আবেদন করতে হবে। পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সংঘটিত অপরাধ গুরুতর আমল-যোগ্য হলেও আপনার অভিযোগের প্রেক্ষিতে থানায় অফিসার ইনচার্জকে মামলার নেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। অন্যথায় আপনার অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি-না, তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোন পুলিশ অফিসারকে দিয়ে তদন্ত করত আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। অভিযোগ প্রাপ্তির পর পুলিশ ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ঘটনাটি সঠিক পাইলে উক্ত অভিযোগের উপর ভিত্তি করে থানায় মামলা হবে। অন্যসব পন্থার মধ্যে এটি সহজতর এবং এতে অর্থ ও সময় কম অপচয় হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়েরঃ
কোনো কারণে পুলিশ যদি থানায় মামলা নিতে না চায়, তাহলে সংক্ষুব্ধ নাগরিক একজন আইনজীবির পরামর্শক্রমে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের আদালতে নালিশি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন। এ প্রক্রিয়ায় মামলা করলে আদালত অভিযোগটি আমলে নিলে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন অথবা আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে থানাকে নির্দেশ দিতে পারেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি থানায় এজাহার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। আবার দরখাস্ত আকারে ঘটনার পূণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজন মনে করলে ঘটনার কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁদের শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন।
পরীক্ষার সারসংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারীর এবং কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁর স্বাক্ষর নেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট ওই পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটিকে একটি সিআর কেস নম্বর (Complaint Register case number) বা সিআরপি কেস নম্বর (Complaint Register Petition case number) দিয়ে নথিভুক্ত করবেন।
একে সিআর মামলাও বলে। তবে শপথ পরীক্ষার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা যদি অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি (Prima facie) প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন। নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে উক্তাদেশ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন।
মনে রাখা জরুরি যে, থানায় এজাহার রুজুর মাধ্যমে কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার আদেশ দিলে রাষ্ট্র তখন মামলার পক্ষ হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। কিন্তু নালিশি মামলার ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ করে পরবর্তী শুনানির দিন যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির না হয় বা ঘটনা তদন্ত শেষে যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ না হয়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি খারিজ করে দিতে পারেন।
অভিযোগকারী চাইলে এ ধরনের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশন আবেদন করতে পারেন। নালিশি মামলা সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই করতে পারেন। অআমলযোগ্য অপরাধের বেলায় বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত করতে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন।
এ ক্ষেত্রেও আদিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযোগটি বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে এবং তদন্তকালীন আমলযোগ্য অপরাধ তদন্ত করার মতোই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। অভিযোগের তদন্ত শেষে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে কিংবা অভিযোগের কোনো ভিত্তি খুঁজে না পেলে পুলিশের দাখিলকৃত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নারাজি দিতে পারেন।
অর্থাৎ পুলিশ প্রতিবেদনে তিনি কেন সন্তুষ্ট নন, আদালতে সে কারণ দর্শিয়ে অভিযোগটির পুনঃতদন্তের আবেদন করতে পারেন। তবে প্রয়োজন মনে করলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অথবা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও তদন্তকাজে সম্পৃক্তকরতে পারেন।
হাইকোর্টে মামলা দায়েরঃ
থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রতিকার চাওয়া যায়। রিট আবেদনে ভিকটিম বা তার পরিবার থানায় মামলা দায়েরের অনুমতি প্রদান ও আসামিদের গ্রেফতারের আদেশ প্রার্থনা করতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করলে পুলিশ রায় মানতে বাধ্য।বিধিবদ্ধ সংস্থায় অভিযোগ করাথানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে পুলিশের উদ্ধতন কতৃপক্ষ ছাড়াও প্রতিকার চাওয়ার অন্য মাধ্যম হলো বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
দরখাস্ত আকারে ঘটনার পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিকট দায়ের করতে হবে। ধর্ষন ব্যতীত অন্যান্য নারী নির্যাতন সংক্রান্তে বিষয়ে পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে প্রতিকার পাওয়ার জন্য পুলিশের ওমান ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের অভিযোগ দায়ের করা যায়। বিশেষ করে নারী নির্যাতন ও মানবিক বিষয়গুলো বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছেও এ ধরনের অভিযোগ দেওয়া যায়। এরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা থানায় আইনের আশ্রয় না পেলে অজ্ঞতা, দৈনতা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। জনগনের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের আইনি সহায়তা প্রদান কর্মসূচিও ব্যাপক পরিসরে বাড়লে উপকার পাবে সাধারণ মানুষ।
জনসচেতনায়- মোঃ সাব্বির রহমান, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত), বাঞ্ছারামপুর মডেল থানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply