মজু চৌধুরীর হাটে নেমে স্বপ্নের প্রথম ধাপে যেন নামলাম। আগের রাতেই একটা খসড়া প্ল্যান করা ছিল কোথায় কোথায় ঘুরবো। তার বাস্তবায়নের প্রথম রূপায়ন করতে ছুটতে হবে লক্ষ্মীপুর। একটি সি.এন.জি রিজার্ভ নিয়ে শুরু হলো পথিকের পথ চলা। প্রায় আধা ঘণ্টা পর সি.এন.জি আমাদের দালাল বাজার নামিয়ে দিল। কত বাজার হাট দেখলাম, দালাল বাজারের নাম জীবনে প্রথম শুনলাম। কী কারণে এই অদ্ভূত নাম, এর কারণ তো জানতে হবে। লোকাল এক চাচার কাছে দালাল বাজারের মাজেজা জানতে পারলাম। দালাল বাজারের সাথে সাথে জানতে পারলাম লক্ষ্মীপুর জেলা নামকরণের ইতিহাস।
আজ থেকে চারশত বছর পূর্বে লক্ষ্মী নারায়ণ বৈষ্ণব নামে জনৈক ভদ্রলোক সুদূর কলকাতা থেকে এই অঞ্চলে কাপড়ের ব্যবসা করতে আসেন। তার নামে লক্ষ্মীপুর জেলার নামকরণ হয়। তার উত্তর পুরুষরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক এজেন্সী এবং পরে জমিদারী লাভ করেন। জমিদারী লাভের পর স্থানীয় মানুষরা তাদের মনে প্রাণে গ্রহণ করেনি। তাদেরকে ব্রিটিশদের দালাল হিসেবে ভর্ৎসনা শুরু করে। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রাণের ভয়ে জমিদারগণ এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
পরে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদারদের পরিত্যক্ত বাড়ীটি রয়ে যায় কালের সাক্ষী হিসাবে। ধরা হয় জমিদারদের এই দালালির কারণেই এই ইউনিয়নের নাম হয়ে যায় দালাল বাজার ইউনিয়ন। কারণ দালাল বাজার থেকে জমিদারদের বাড়ীটি অতি কাছে। আমরা শীঘ্রই সে বাড়ী পরিদর্শন করতে যাব। এর আগে পেটের আগুন তো নিভাতে হবে। সকালের নাস্তা পরোটা, ভাজি, ডিম দিয়ে সারলাম। নাস্তা পর্ব শেষে দুধের মতো সাদা ধব ধবে দইয়ের বাটি দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম দই। এমন স্বাদের দই, এতদিন পরেও মুখে যেন স্বাদ লেগে আছে।
বাজার থেকে পদবজ্রে রওনা হলাম জমিদার বাড়ীর পথে। যা এখন দালাল বাজার জমিদার বাড়ী হিসাবে পরিচিত। বাজার থেকে খানিকটা হেঁটে বাম দিকের সরু গলির ভেতর ঢুকে গেলাম। গলির ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেলাম কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মহারথী। যেন জীর্ণশীর্ণ ভগ্ন দেহে জানান দিচ্ছে লক্ষ্মীপুরের ইতিহাস। এত চমৎকার নির্মাণশৈলীর এই জমিদার বাড়ীটি কংকাল স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে মান অপমান গ্লানির বোঝা মাথায় নিয়ে। কী অপূর্ব ছিল এককালে এই জমিদার বাড়ীটি। তার প্রতিটা পরতে পরতে তাকিয়ে থেকেই বোঝা যায়। লাল ইটের দেয়াল পেরিয়ে আমরা দেখতে লাগলাম জমিদার বাড়ীর অস্থিমজ্জা।
এটি আজ সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের মুখে। প্রায় ৫ একরের এ জমিদার বাড়ীর সম্মুখের রাজগেট, রাজ প্রাসাদ, জমিদার প্রাসাদ, অন্দর মহল প্রাসাদ, বাড়ীর প্রাচীর, শান বাঁধানো ঘাট, নাট মন্দির, পুজা মণ্ডপ প্রভৃতি দেখার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। ঘুনে ধরা ইতিহাসের পাতায় থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমাদের পাহাড়প্রেমী ওয়াফি আহমেদের মনও দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। অন্য সব দেশে যা করা হয় সংরক্ষণ, আমাদের দেশে তা করা হয় ধ্বংস। এখানে ফটো সেশনের পর্ব শেষ করে দু’পা বাড়ালাম কামানখোলা জমিদার বাড়ীর দ্বারে।
কামানখোলা যাবার জন্য রিক্সা ঠিক করলাম। রিক্সা চলছে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে। নারিকেল, সুপারি গাছের ঝাঁক পিছে ফেলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ত্রিচক্রযান সবুজের মায়ায়। সুপারি গাছগুলো যেন আকাশ থেকে ছুঁড়ে দেয়া ঈশ্বরের তীর। লিকলিকে লম্বা কাঠি গেঁথে আছে মাটিতে, শূন্যে তার এক গুচ্ছ পালক। যে দিকে তাকাই সুপারি গাছের এই সমাহার শেষ হয় না। সরু রাস্তার দুই ধারে নারিকেল সুপারি গাছের বাগান। নারিকেল, সুপারি ভরপুর বিখ্যাত জেলা লক্ষ্মীপুর। সুপারি গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় মুখচোরা বাবলা গাছ।
ফুরফুরে বাতাসে মনে এক অসাধারণ অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। যাত্রা পথে সন্ধান পেলাম বাঁশের তৈরি মাচাং ঘরের। ক্লান্তি আমারে ক্ষমা করো প্রভু….পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু। যাক না পিছিয়ে, কত আর পিছাবো? অবসাদ জেঁকে বসেছে দেহে, গা এলিয়ে দিলাম প্রকৃতির বুকে। আকাশে শুভ্র মেঘের সারি নেমে আসছে যেন শরতের আহ্বানে। মৃদু মৃদু দক্ষিণা হাওয়ায় চোখ চলে যেতে চায় ঘুমের রাজ্যে। শরতের এই সুন্দর দুপুরে বাধ সাধলো বেরসিক ওয়াফি আহমেদ৷ আশিক ভাই চলেন না, দেরি হয়ে যাবে তো। ফিরে এলাম আমাদের ত্রিচক্রযানে।
কিছুটা দূরে যাবার পর রাস্তা আরও সরু হয়ে গেল বিধায় নেমে পড়লাম রিক্সা থেকে। পায়ে হেঁটে যাচ্ছি তিন জন অদ্ভুত মানুষ। পথের দু’ধারে সেই চিরচেনা সুপারি গাছের সারি। বেশ কিছু দূরে লালচে আভার মতো কী যেন ভেসে আসছে। মঠ টাইপের কিছু হবে ভেবে হাঁটার স্পীড বাড়িয়ে দিলাম। যাওয়ার পথেই পেলাম জমিদার বাড়ীর বিশাল দীঘি। গোসল করার তীব্র লোভ সংবরন করে সামনের দিকে আগালাম। রাস্তার শেষের দিকে এসে পেলাম জমিদার বাড়ীর তিনতলা বিশিষ্ট মঠখানা। শৈল্পিক অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে গিয়ে যেন আমাদের ওয়াফি লিওনার্দো ভিঞ্চি হয়ে গেল। শিল্পীর কচি মনে আঘাত দিতে নেই বলে, আমি আর জুয়েল ভাই এই শৈল্পিক অত্যাচার নীরবে সইতে লাগলাম।
অত্যাচার শেষে পা বাড়লাম মূল জমিদার বাড়ীর দিকে। এখানেও একটা পুকুর আছে। পুকুরের পাশ দিয়ে সরু পথে গুটি গুটি পায়ে চলে এলাম আমরা একটা সাদা নতুন রঙ করা দোতলা ভবনের সামনে। ভবনের আশেপাশে বেশ কয়েকটা টিনের ঘর, মাটির ঘর পরিলক্ষ করলাম। এটা ছিল ভবনের পিছনের অংশ। মূল তোরণ দিয়ে ভেতরে ঢুকেই পেয়ে গেলাম সেই আদি ও প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী।
আগের দিনের মানুষরা আধুনিক যুগের মানুষ থেকেও যে শৌখিন ছিল তাদের তৈরি স্থাপনা দেখলেই বোঝা যায়। প্রতিটি স্থাপনায় ফুটে উঠেছে রুচিশীলতার পরিচয়। এই সেই বিখ্যাত কামানখোলা জমিদার বাড়ী, নামেই যার আর্কষণ। এই জমিদার বাড়ী সম্পর্কে বেশি তথ্য জানা যায়নি। তবে তাদের উত্তর পুরুষরা এখনও এই বাড়ী ব্যবহার করে।
কামানখোলা জমিদার বাড়ী।
“জমিদার রাজেন্দ্র নাথ দাস পুত্র ক্ষেত্রনাথ দাস ও পৌত্র যদুনাথ দাস এবং যদুনাথ দাসের পৌষ্যপুত্র হরেন্দ্র নারায়ণ দাস চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারী করেন। রায়পুর উপজেলায় তাদের জমিদারী ছিল। দালাল বাজারের জমিদারদের সাথে সখ্য থাকায় এ জমিদার বাড়ীর নিকটবর্তী কামান খোলায় ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করে জমিদারী আবাস গড়ে তোলেন। বাড়ীর সদর দরজায় খালের পাড়ের জল টংগী, লাঠিয়াল ও রক্ষী বাহিনীর আবাস, সামনে দ্বিতল লম্বা বিরাটাকারের পুজা মণ্ডপ।
সুরক্ষিত প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতর বাড়ীতে অপূর্ব সৌন্দর্যের রাজ প্রাসাদ। বাড়ীর অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ নৃত্য ও সালিশী কক্ষ তথা ‘আঁধার মানিক’ নামে খ্যাতে কক্ষ নিয়ে নানা মুখরোচক কাহিনী রয়েছে। হাতিমারা গেছে কিন্তু সে হাতির হাড় আছে। আছে লক্ষ্মী নারায়ন দেব বিগ্রহ।”
[ইতিহাসের তথ্যসূত্রঃ www.lakshmipur.gov.bd]
কিছু আশা, হতাশা, প্রত্যাশা নিয়ে জমিদার বাড়ীর উঠান পেরিয়ে এসে পড়লাম আবার লক্ষ্মীপুর সদরে। স্থানীয় মানুষজনকে জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে দেখিয়ে দিল আলেকজান্ডারের বাস স্ট্যান্ড। বাস স্ট্যান্ড গিয়ে বাসে ভীড় দেখে উঠে বসলাম আলেকজান্ডার যাবার লেগুনায়। উঠিয়া দু’চোখ মুদিলাম। এবার যাত্রা সেই স্বপ্নের আলেকজান্ডারে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply