রাশিয়া বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ কোনটি? বিতর্ক সাপেক্ষে বলা যেতে পারে, স্পেন-পর্তুগাল কিংবা জার্মানি-মেক্সিকো, অথবা অন্য কোনো ম্যাচ।
তবে হৃদকম্পন ধরিয়ে দেবার মতো ম্যাচ কিন্তু বিতর্ক ছাড়াই বলে দেয়া যায়, গতরাতের আর্জেন্টিনা- নাইজেরিয়ার কথা।
‘ডি’ গ্রুপের সমীকরণটা জানত সবাই। শেষ ষোলোয় উঠতে হলে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে জিততেই হবে। পাশাপাশি নির্ভর করতে হবে ক্রোয়েশিয়া-আইসল্যান্ড ম্যাচের ফলেও। তবে নাইজেরিয়াকে হারিয়ে নিজেদের কাজটা সেরে রাখতে হতো হোর্হে সাম্পাওলির শিষ্যদের। আফ্রিকার দলটিকে ২-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের কাজটা ঠিকই সেরেছেন মেসিরা।
অন্য ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া ২-১ গোলে আইসল্যান্ডকে হারানোয় মেসিদের নকআউট পর্বে ওঠা নিশ্চিত হয়ে যায়। ‘ডি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে শেষ ষোলোয় উঠেছে ক্রোয়েশিয়া। এই গ্রুপের রানার্সআপ দল হিসেবে শেষ ষোলোয় উঠল আর্জেন্টিনা।
মেসির দুর্দান্ত এক গোলে ১-০ গোলে এগিয়ে প্রথমার্ধ শেষ করেছিল আর্জেন্টিনা। বিরতি শেষে মাঠে নামার আগে সতীর্থদের প্রতি কিছু পরামর্শও দেন মেসি। বোঝাই যাচ্ছিল, ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচের বাকি সময়টুকুতে আর কোনো ভুল চুক করা চলবে না, এমনটাই বোঝাচ্ছিলেন আর্জেন্টাইন জাদুকর। কিন্তু দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়টাই সতীর্থের কথা রাখতে পারেননি!
৪৯ মিনিটে কর্নার পায় নাইজেরিয়া। রক্ষণ আঁটসাঁট করতে গিয়ে নাইজেরিয়ার বালুগানকে বক্সের মধ্যে ফেলে দেন মাচেরানো। যদিও সেই পরে যাওয়ায় বালুগানের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু দ্রুতই ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির (ভিএআর) সাহায্য নিয়ে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। ৫১ মিনিটে স্পটকিক থেকে ভিক্টর মোজেসের সমতাসূচক সেই গোল শেল হয়ে বিঁধেছে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের বুকে।
প্রথমার্ধে দাপিয়ে খেলেছে আর্জেন্টিনা। নাইজেরিয়া বলতে গেলে পাত্তাই পায়নি। এ সময় ৬২% বল দখলে রেখে নাইজেরিয়ার গোলপোস্টে ৫টি শট নিয়েছেন মেসিরা। অথচ এই দলটাই কি না পেনাল্টি থেকে গোল হজমের পর প্রায় ২৫ মিনিট পর্যন্ত নাইজেরিয়ার গোলপোস্টে কোনো আক্রমণ করতে পারেনি!
তার আগে আর্জেন্টিনার আশার ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছিলেন মেসি। প্রথমার্ধের শুরু থেকেই ত্রাস ছড়িয়েছেন নাইজেরিয়ার রক্ষণে। ১০ মিনিটের মধ্যে দুটি আক্রমণ করেছিলেন, হয়নি। মাঝমাঠে এভার বানেগাকে খেলানোয় ধার বেড়েছিল আর্জেন্টাইন আক্রমণভাগের। প্রথমার্ধে দারুণ খেলেছেন এই মিডফিল্ডার। ১৪ মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে বানেগার দারুণ এক পাস বাম উরু দিয়ে নামিয়ে ডান পায়ের শটে ছবির মতো এক গোল করেন মেসি।
প্রথমার্ধে মেসির তুলনা তিনি নিজেই। এ সময় নাইজেরিয়ার গোলপোস্টে দুটি শট নিয়েছেন মেসি। একটিতে চোখ রাঙালেও আরেকটিতে ঠিকই গোল পেয়েছেন। এ ছাড়াও সতীর্থদের নিয়ে নাইজেরিয়ান বক্সের সামনে গোলমুখ খোলার প্রচেষ্টা তো ছিলই। আগের দুই ম্যাচে সেভাবে জ্বলে উঠতে না পারায় আজ মেসি যেন কড়ায়-গন্ডায় সব পাওনা তুলে নিতেই মাঠে নেমেছিলেন! প্রথমার্ধের গোলটা থেকে মেসি সেই পাওনার কিছুটা হলেও বুঝে পেয়েছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপের শততম গোলটা যে এসেছে মেসির পা থেকে!
কিন্তু মেসির এই গোলটার কোনো মূল্য থাকত না যদি ৮৬ মিনিটে রোহো ত্রাণকর্তা না হয়ে উঠতেন। গোল হজমের দুঃখে কুঁকড়ে যাওয়া আর্জেন্টাইন আক্রমণভাগের আড়মোড়া ভাঙতে প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট সময় লেগেছে। এরপরই ভেলকি দেখাতে শুরু করেন মেসি-বানেগা-পাভন-আগুয়েরোরা। সাম্পাওলির পছন্দের প্রেসিং ফুটবল খেলতে শুরু করেন তাঁরা। এ সময় নাইজেরিয়ান ডিফেন্ডারেরা রক্ষণভাগ স্রেফ গোল বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছে।
ধারাবাহিক এই চাপের ফসল হিসেবেই নির্ধারিত সময়ের ৪ মিনিটে ‘কোমা’ থেকে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা।
সেই প্রাণের সঞ্চারটুকু করেছেন রোহো। ডান প্রান্ত থেকে ক্রস করেছিলেন গ্যাবি মার্কাদো। আর নাইজেরিয়ান বক্সে একেবারে চোস্ত স্ট্রাইকারদের মতো ওত পেতে ছিলেন ২৮ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার। ক্রসটা পেয়েই রোহোর ভলি শুধু নাইজেরিয়ার জালই স্পর্শ করেনি সঙ্গে দেশটির আপামর সমর্থকদের মনও ভেঙেছে। এই হারে নাইজেরিয়া যে ছিটকে পড়ল গ্রুপপর্ব থেকে।
আর্জেন্টিনা গ্রুপের রানার্সআপ হিসেবে উঠে গেল শেষ ষোলোয়। এরপর তাদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। গতরাতের সেই প্রাণশক্তিটুকু ধরে রেখে ফ্রান্সের বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে কি না, সেটির দিকেই তাকিয়ে আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা।
Leave a Reply