অনলাইন ডেক্সঃ নাটোরের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় যমুনা টিভির স্টাফ রিপোর্টার ও দৈনিক খোলা কাগজের জেলা প্রতিনিধি নাজমুল হাসানকে হুমকি দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুটি নাম্বার থেকে ফোন করে হুমকি দেয়া হয়। এব্যাপারে নাজমুল হাসান নাটোর সদর থানায় একটি জিডি করেছেন।
জিডির বিষয়টি নিশ্চিত করে নাটোর সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত জানান, সাংবাদিক নাজমুল হাসানকে হুমকির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্তদের আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে।
এদিকে রাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে নাজমুল হাসান বলেন, আমি ও আমার অফিস দুর্নীতি মুক্ত। এমন সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রকাশ্যে দুর্নীতি করছে নাটোর পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তা নিয়ে সংবাদ করায় আবার হুমকি ধামকিও পাচ্ছি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরপর দুটো নাম্বার থেকে ফোন আসলো। নাম পরিচয় না দিয়ে সে কি হুঙ্কার! আপাতত আইন-শৃঙ্গলা বাহিনীকে বলেছি। তারা ভদ্রলোকদ্বয়কে খুঁজে পেলে আমি বরাবরের মতই তাদের সাথে কফি খাবার ইচ্ছে রাখি। যমুনা টেলিভিশনের সংবাদে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। আশা করি প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ নাটোরবাসী পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি রুখে দেবে।
প্রসঙ্গত, ‘এ যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার! নাটোরের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সীমাহীন দুর্নীতি’ শিরোনামে সম্প্রতি একটি সংবাদ প্রকাশ করেন যমুনা টিভির স্টাফ রিপোর্টার ও নাটোর প্রেসক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক নাজমুল হাসান।
সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়, নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি কিছুতেই দুর হচ্ছে না। অফিসেরই কর্মকর্তা কর্মচারী এমনকি পরিচ্ছন্নকর্মীও জড়িয়ে পড়েছে ঘুষ বানিজ্যে। এখানে বাইরের দালাল চক্র নয়, অফিসের-ই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সেবা গ্রহীতারা। অলিখিতভাবেই পাসপোর্ট প্রতি ১২শ টাকা ঘুষ নির্ধারণ করা হয়েছে। বারবার গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দুর্নীতির চিত্র উঠে এলেও কর্মকর্তারা বরাবরের মতোই তা অস্বীকার করেছেন। তবে অনিয়ম প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
সম্প্রতি অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের গেটে ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতি এবং দালাল মুক্ত’ এই সাইনবোর্ডের নিচেই আনসার সদস্য জাহিদ হাসানের অবৈধ কর্মকান্ডের চিত্র। নিজ দায়িত্ব পালন না করে অন্যের ফরম পুরনে ব্যস্ত তিনি। জানা গেল ১২’শ টাকা হাতিয়ে নিতেই এতো তোড়জোড় তার। এ যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার!
পাসপোর্ট করতে আসা ভুক্তভোগী নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার রামশার কাজিপুরের বাসিন্দা সামাদ আলী জানান, হয়রানি থেকে মুক্ত হতেই তিনি আনসার সদস্যের হাতে ১২’শ টাকা দিয়েছেন। তবে আনসার সদস্য জাহিদ হাসান তা অস্বীকার করেন।
এরপরে হয়বতপুরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের ফরম হাতে দেখা মেলে পাসপোর্ট অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাখালের। এখানেও ১২’শ টাকায় দফারফা। রাখালকে নিয়ে বায়োএনরোলমেন্ট (ফিঙ্গার ও ছবি তোলার) রুমে গিয়ে প্রশ্ন করা হয়, কেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর হাতে ফরম?
এমন প্রশ্নের কোনই সদুত্তর দিতে পারেননি হিসাব রক্ষক সাইফুল ইসলাম ও উচ্চমান সহকারী শরিফুল ইসলাম। তবে ঘুষের টাকা ভাগাভাগির সরল স্বীকারোক্তি দেয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাখাল। সে জানায়, ঘুষের টাকা সে আর আনসার সদস্য জাহিদ হাসান ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
সুযোগ পেয়ে অনিয়ম ও হয়রানির নানা ফিরিস্তি তুলে ধরেন ভুক্তভোগী অনেকেই। মোস্তাফিজুর রহমান সৈকত নামে এক ভুক্তভোগী জানান, নাটোর পাসপোর্ট অফিসে উচ্চমান সহকারী শরিফুল ইসলাম সবচেয়ে বেশী হয়রানি করেন। যার কারেণে অসহায় হয়ে মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। একটা ফরম পুরণ করতে কতো সমস্যা তিনি বের করেন তা বলার মতো নয়। তবে টাকা দিলে সব ঠিক হয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানান, পাসপোর্ট করতে গেলে প্রথমেই আনসার সদস্যরা গেটে আটকে দেন। তারপর ১২’শ টাকার কথা বলেন। টাকা না দিলে ফিঙ্গার হয় না। ঘুষ দিলে সবার আগে ফিঙ্গার নেন হিসাব রক্ষক সাইফুল ইসলাম। অফিসের সবাই ঘুষের টাকা ভাগাভাগি করে নেয়। এর মধ্যে রয়েছে আনসার সদস্য সাইফুল ও জাহিদ হাসান, উচ্চমান সহকারী শরিফুল ইসলাম, হিসাব রক্ষক সাইফুল ইসলাম।
মামুনুর রশীদ নামে এক যুবক জানান, পাসপোর্ট অফিসে আমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তা জীবনেও ভুলবো না। নাটোরের ছেলে হয়েও আমার পাসপোর্ট এখনো হয়নি। রাগে দুঃখে আমি পাসপোর্ট পাবার হাল অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছি। ওদের চেয়ে বেঈমান, দুর্নীতিবাজ ও খারাপ লোক আমি খুব কমই দেখেছি।
রনক হাসান নামে এক ভুক্তভোগী জানান, অনিয়মের প্রতিবাদ করায় শরিফুল ইসলাম বলেছে, কিভাবে পাসপোর্ট পাই তা দেখবে। অনিয়ম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চান সেবাগ্রহীতারা।
বরাবরের মতোই সব অভিযোগ অস্বীকার করে নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আলী আশরাফ জানান, এখানে কেউ টাকা নেয় না। টাকার সাথে কোন সম্পর্ক নাই। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছে। কেউ ঘুষ নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কি ধরনের ব্যবস্থা নেবেন, এমন প্রশ্নে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, কি ব্যবস্থা নেবো তা আপনাকে বলতে হবে নাকি?
নাটোর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, জনগণের দোরগোড়ায় দ্রুত সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের আগষ্ট মাসে শহরের চকরামপুর এলাকায় নাটোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। জরুরি পাসপোর্ট গ্রহণের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ৬ হাজার ৯শ’ টাকা আর সাধারণ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ফি ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। এর বাইরে পাসপোর্ট প্রতি যে ১২’শ টাকা ঘুষ নেয়া হয় তা খুবই দুঃখজনক। এর প্রতিকার হওয়া জরুরি। কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে দ্রুত যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়।
জনগণের হয়রানি বন্ধে নাটোর পাসপোর্ট অফিসের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ। তিনি বলেন, জনগণের হয়রানি বন্ধে দ্রুত কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়া হবে।
এব্যাপারে নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেছেন, বিগত সময়ে পাসপোর্ট অফিসে অনিয়মের বিষয়ে কথা উঠেছিল। তা জানার পর আমি জেলা প্রশাসক ও পুলিশের মাধ্যমে তা তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সে সময় অনিয়ম বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে শুনলাম আবারো ঘুষ নেয়া শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে অবশ্যই আমি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেবো। নাটোরে কোন অন্যায় দুর্নীতিকে প্রশ্চয় দেয়া হবে না। পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ বানিজ্য কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply