ঠিক যেন দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার গল্প। নাটোরের জমিদার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দেখতে পেলেন অপরূপ সুন্দরী এক মেয়েকে। সেই মেয়ে অবশ্য কোনো আশ্রমকন্যা ছিলেন না। তিনিও ছিলেন জমিদারের মেয়ে। তবে তাঁর বাবা আত্মারাম চৌধুরীর জমিদারি নাটোরের থেকে অনেকই ছোটো। সে যাই হোক, রামকান্ত সেই মেয়েকেই বিয়ে করবেন বলে পণ করে বসেছেন। এত বড়ো জমিদারের কথায় না কীভাবে বলেন আত্মারাম? আর সুবর্ণ সুযোগ যখন সোজা বাড়ির দরজায় হাজির। কিন্তু মেয়ে বড্ড জেদি। তিনি বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য তিন তিনখানা শর্ত রেখে বসলেন। এক, বিয়ের পর এক বছর তাঁকে বাপের বাড়িতে থাকতে দিতে হবে। দুই, এলাকার দরিদ্র মানুষকে দান করতে হবে জমি। আর তিন নম্বর শর্তটা আরো অদ্ভুত। বাবার জমিদারি ছাতিয়ান থেকে নাটোর পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে সেটা লাল শালু দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যার ওপর দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন তিনি। রামকান্ত অবশ্য প্রত্যেকটা শর্তই মেনে নিলেন। আর বিয়ের পর সেই মেয়ে হয়ে উঠলেন নাটোরের জমিদারগিন্নি, রানি ভবরানি ভবানীর বিয়ে নিয়ে প্রচলিত আছে এমনই গল্প।
তবে, জমিদারগিন্নি থেকে তাঁর রানি হয়ে ওঠার পথটা অবশ্য অনেকটাই দীর্ঘ। তাঁর এবং রামকান্তের তিন সন্তানের মধ্যে শুধু মেয়ে তারাসুন্দরী বাদে দুই ছেলে খুব ছোটোবেলাতেই মারা যান। এই তারাসুন্দরীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পরে রামকৃষ্ণ নামের একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন রানি ভবানী। রামকান্তও অকালে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। তখন অবশ্য বাংলার নবাব ছিলেন সিরাজের দাদু আলিবর্দি খাঁ। নাটোরের জমিদার মারা যাওয়াতে নবাব আলিবর্দি নাটোরের জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেন রানি ভবানীর হাতে। এই রানি ভবানীর জমিদারি বিস্তৃত ছিল এখনকার রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ছাড়িয়ে মালদা পর্যন্ত।
১৭৪৮ থেকে ১৮০২ সাল পর্যন্ত ৫৪ বছর ধরে এত বিশাল জমিদারি সামলিয়ে তিনি পরিচিত হলেন ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’ নামে। জমিদারির তরফ দেখে নবাবকে রাজস্ব দিতেন বছরে প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা। অর্থাৎ তখনকার দিনে খুব বড়ো একটা অংক। হলওয়েল সাহেব লিখে গেছেন, নবাব এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি – দু’পক্ষই রানিকে বেশ সমীহ করে চলতেন। তবে, পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষ নিয়ে লড়ার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলেন রানি ভবানী।
এত কিছুর পরও প্রজাদের জন্য যা কিছু করে গেছেন তা প্রবাদপ্রতীম। জল খাওয়ার জন্য অসংখ্য জলাশয়, পথিকদের জন্য পান্থশালার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভবানী জাঙ্গাল’ নামের সেতু আর রাস্তাও তৈরি করিয়েছিলেন। হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত রাস্তার ব্যবস্থা করেছিলেন, কাশীতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভবানীশ্বর শিব মন্দির। ব্রাহ্মণদেরও দান করতেন প্রচুর টাকা। আরও কত যে মন্দির তিনি স্থাপন করেছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শোনা যায়, বিয়ের আগে বাবার জমিদারি অঞ্চলে তিনি ৩৬০টা পুকুর খুঁড়িয়েছিলেন আর প্রত্যেকদিন আলাদা আলাদা পুকুরে স্নান করতেন। জমিদারির কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন দেওয়ান দয়ারাম। তাঁর মতো সৎ, বিশ্বস্ত আর কর্মঠ অনুচর খুবই দুর্লভ। এদিকে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হলে রানির দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তির ওপর কর বসতে থাকে। পাঁচশালা বন্দোবস্তে কোম্পানির রাজস্বও ছিল খুব চড়া। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁইয়া হয়ে পড়েছিল। তারপর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত পালিত ছেলে রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি তুলে দিয়ে রানি ভবানী চলে যান স্বেচ্ছায় গঙ্গাবাসে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply