সবাইকে চমকে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। সোমবার (১১ মার্চ) গভীর রাতে নির্বাচন কমিশন যখন ভোটের ফল ঘোষণা করে, তখন হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী শিক্ষার্থীদের জনপ্রিয় এ মুখ।
আগে থেকেই আলোচনায় ছিলেন নুর। তবে, নির্বাচনের পর নুরুল হক নুর সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়েছে সবার। অথচ এই নুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছিল সংশয়। কারণ তার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কোন পরীক্ষায়ই তার জিপিএ ফাইভ ছিল না।
জানা যায়, নুর ২০১০ সালে গাজীপুর জেলা কালিয়াকৈর গোলাম নবী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৪.৯২ ফলাফল অর্জন করে এবং ২০১২ সালে ঢাকা উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ একই ফলাফল অর্জন করে। এরপর ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুযোগ পায়।
নুর পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের উত্তর চরবিশ্বাস গ্রামের ইদ্রিস হাওলাদারের ছেলে। ডাকসু নির্বাচনে তিনি সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নুরুল-রাশেদ-ফারুক প্যানেলে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছেন।
এছাড়া তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নুরুলের বিজয়ে গলাচিপার সর্বস্তরের জনগন আনন্দ প্রকাশ করছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পিতা ইদ্রিস হাং ১৯৭৫ সালে পটুয়াখালীর জেলার বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের শৌলা গ্রামের পৈত্রিক নিবাস ছেড়ে নুরুলের দাদা ও ৩ চাচা গলাচিপার উত্তর চরবিশ্বাস এলাকায় বসবাস শুরু করে।
১৯৯১ সালে তার পিতা ইদ্রিস হাং নিজ এলাকায় ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। তার ৬-৭ কানি জমি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নুরুলের ৬ বছর বয়সে তা মা নিলুফা বেগম মারা যায়। নুরুলের ৫ বোন ও ৩ ভাই রয়েছে। ৩ ভাইয়ের মধ্যে নুরুল মেঝ। নুরুলের বড় ভাই নুরুজ্জামান হাং ও ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম ঢাকা উত্তরা এলাকায় মুদি মনোহরী ও গেঞ্জি বিক্রির ব্যবসা করে। তার ৫ বোনের মধ্যে তিন বোন বিবাহিত। বাকি দুই বোন মধ্যে সীমা আক্তার দশমিনা কলেজ থেকে ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে এবং ইতি আক্তার চর বিশ্বাস জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে।
এদিকে, নুরুল ২০১০ সালে গাজীপুর জেলা কালিয়াকৈর গোলাম নবী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৪.৯২ ফলাফল অর্জন করে এবং ২০১২ সালে ঢাকা উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ একই ফলাফল অর্জন করে। এরপর ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুযোগ পায়।
এ ব্যাপারে নুরুল হক নুর এর বাবা ইদ্রিস হাওলাদার জানান, ছেলের বিজয়ে আমার এলাকার সর্বস্তরের জনগন খুব খুশি। এ বিজয় আপনাদের সকালের। আমার ছেলে ভবিষ্যতে যাতে বড় কিছু হতে পারে তার জন্য তিনি সবার জন্য দোয়া চেয়েছেন।
নুর কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা ও কারাবরণের মুখোমুখি হন। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জয় হয় নুরসহ কোটা আন্দোলনকারী নেতাদের।
শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, পরবর্তী সময়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন নুর। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে তুলে ধরেন দেশবাসীর কাছে। কোটা আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে যুক্ত করেন।
এই দুটি আন্দোলন নুরকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা যেখানে নিজ দলের লেজুড়বৃত্তি করে, সেখানে নুর শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করেন। এটিই অন্যদের চেয়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
সবশেষ সোমবার ডাকসু নির্বাচন চলাকালে নির্বাচনে রোকেয়া হলকেন্দ্রে ভোটের অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়ে সংজ্ঞা হারান নুর। তার পরও তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাকেই নেতা নির্বাচিত করেছেন।
হাসপাতালের বেডে শুয়েই ভিপি পদে জয়ের খবর পান নুর। ‘প্রহসনের ভোটে’ প্যানেলের সব প্রার্থীর পরাজয়ের মাঝে ভিপি পদে এ জয় যে তাকে খুব একটা খুশি করতে পারেনি, সেটি বোঝা গেল তার কথায়।
সোমবার রাত ৩টার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় নুর বলেন, এ রকম নির্বাচন আমাদের কারোরই প্রত্যাশা ছিল না। প্রায় তিন যুগ পর এই নির্বাচন হলো। সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে ছিল এই ভোটে। কিন্তু প্রত্যাশিত ভোট হয়নি। ডাকসু নির্বাচন কলঙ্কের ইতিহাস সৃষ্টি করল।
‘জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছিল— আমরা ভেবেছিলাম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে আশার আলোর সঞ্চার করা হবে’-যোগ করেন নুর।
কারচুরি অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ যে কারচুপি করেছে তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো দেশকে হতাশ করেছে। আমরা মনে করি, ১১ মার্চের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
এরপর মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে প্রথম ক্যাম্পাসে ঢুকেই হামলার শিকার হয় নুর। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে হামলা করেছে বলে অভিযোগ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের।
এই হামলার প্রতিবাদে ও ২৩টি পদে ফলাফল পুনর্বিবেচনার দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি দেন ভিপি নুর।
পরে বিকেলে ভিপি পদে নুরকে শুভেচ্ছা জানান একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। সেখানে কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন নুর। বুধবারের সব ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন তিনি।
এসময় ছাত্রলীগ সভাপতি সবাইকে একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরার আহ্বান জানান।
টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন বলেন, ‘আমাদের সবার চাওয়া-পাওয়া নুরুল হক পূরণ করবেন। আমি পারিনি কী হয়েছে, নুরুল হক পূরণ করবে। সে জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, যেন স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ঠিক থাকে।’
এ সময় নুরুল হক ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। জবাবে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক বলেন, ‘ছাত্রলীগ আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাই। আমার ওপর ছাত্রলীগ যে হামলা করেছে, তা বিচারের দায়িত্ব আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর ও ছাত্রলীগ সভাপতির ওপর দিলাম।’
পরে তিনি বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, সেটা প্রত্যাহার করে নিলাম।’
পরে মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যায় ঢাবি ক্যাম্পাসে ডাকসু নির্বাচনে ভিপিসহ সকল ফলাফল বাতিল করে নতুন করে ফের নির্বাচনের দাবি জানান নুরুল হক নূর।
নুর অভিযোগ করে বলেন, এখানে আগের রাতে ব্যালট ভর্তি করে রাখা হয়েছে। এই যে নির্বাচনের অস্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়া ছিল এবং শিক্ষার্থীদের যে দাবী ছিল একাডেমী ভবনের বাইরে ভোটকেন্দ্র করা, প্রশাসন এগুলোর কোনটি না মেনে তাদের ইচ্ছেমত ছক অনুযায়ী নির্বাচনটি করেছে। যে কারণে আজকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। সে কারণে আমরা পুনরায় নির্বাচনের দাবী জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট হয়, কিন্তু আমাদের এখানে স্টিলের বাক্সে ভোট হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে ভোটের টাইম সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, যে কারণে অনেক শিক্ষার্থী ভোট দিতে পারেনি।
তিনি জানান, ছাত্র সংগঠনগুলোর চলমান ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিতে তার সমর্থন থাকবে।
উল্লেখ্য, গতকাল সোমবার (১১ মার্চ) দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর দিনভর অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ও বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন, প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণার পর রাতে ফল ঘোষণা হয়। ঘোষিত ফল অনুযায়ী ১৮টি হল সংসদের ১২টিতে ভিপি ও ১৪টিতে জিএস পদে ছাত্রলীগ এবং ৬টিতে স্বতন্ত্ররা ভিপি পদে ও ৪টিতে জিএস পদে জয় লাভ করে। এরপর গভীর রাতে ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণা হলে জিএস, এজিএসসহ সিংহভাগ পদে ছাত্রলীগ জয় পেলেও ভিপি পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর জয়লাভ করেন।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply