একসঙ্গে আট-দশটি মুরগির পা দড়ি দিয়ে বেঁধে উল্টো করে নিয়ে যাচ্ছেন একজন মুরগি ব্যবসায়ী। ব্যথায় মুরগিগুলো কোঁকাচ্ছে, ছটফট করছে। মানুষের কাছে এ দৃশ্য নতুন নয়। ব্যবসায়ী বা ক্রেতা কেউ মুরগির এই আর্তনাদ আমলে নেন না। তাঁরা জানেনও না এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। আর যাঁরা জানেন, তাঁরাও আইনটি প্রয়োগ করেন না।
জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন, ১৯২০-এর ৪(খ) ধারায় জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতাসহ হত্যার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। এখানে জীবজন্তু বলতে গৃহপালিত বা আটককৃত জন্তুকে বোঝানো হয়েছে। এই আইনে বলা আছে, ‘কোনো লোক যদি কোনো জন্তুকে এমনভাবে বাঁধিয়া রাখে, যাহাতে জন্তুটি কষ্ট পায় বা জন্তুটি যন্ত্রণা ভোগ করে। এই অপরাধের জন্য এক শত টাকা জরিমানা কিংবা অনূর্ধ্ব তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হইবে।’
জানতে চাইলে রাজশাহী জজ কোর্টের আইনজীবী এজাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিচারকের চোখে পড়লে বিচারক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ড দিতে পারেন। কেউ অভিযোগ করলেও বিচারক আমলে নিতে পারেন।
এটা যে শুধু দণ্ডনীয় অপরাধ, তা-ই নয়। শিশুদের পাঠ্যবইয়েও এ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জন্য সচেতনতামূলক একটি পাঠ রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘জীবে দয়া’ নামে পাঠ রয়েছে। এর শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আমরা হাটবাজার থেকে হাঁস-মুরগি কিনে এদের পা ধরে বাড়ি নিয়ে আসি। পা উপরে থাকে। মাথা নিচের দিকে থাকে। ফলে এদের কষ্ট হয়। খুব ব্যথা লাগে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। কাঁদতে থাকে। এটা খুব অন্যায় কাজ…’।
রাজশাহী নগরের অনন্যা শিশু শিক্ষালয়ের পরিচালক মাসুদ রানা বলেন, একজন শিশুকে মানবিক হয়ে ওঠার জন্য যেকোনো প্রাণীর প্রতি তারা যেন নির্দয় আচরণ না করে, সে জন্য শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তাদের পাঠ্যসূচিতে এ রকম সচেতনতামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু আইন অমান্য হবে এ জন্য নয়, নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক কারণেও জীবজন্তুকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।
জেলার দুর্গাপুর থেকে রাজশাহী নগরের সাহেব বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি মুরগি সরবরাহ করেন আসাদুল ইসলাম। তিনিও পাঁচ-সাতটা করে মুরগি একসঙ্গে উল্টো করে পা বাঁধা অবস্থায় দোকানে সরবরাহ করছেন।
মুরগি কষ্ট পাচ্ছে। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ—এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আসাদুল বলেন, আইন মেনে মুরগি দিতে গেলে অনেক দেরি হবে। বাজারে ভিড় লেগে যাবে। তখন ঝামেলায় পড়তে হবে।
নগরের সাহেব বাজার থেকে মোটরসাইকেলের পেছনে মুরগি উল্টো করে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক ক্রেতা। সামনে তাঁর বাচ্চাকে বসিয়েছেন। পেছনে উল্টো করে বাঁধা মুরগি কোঁ কোঁ করছে। তাঁকে থামিয়ে মুরগির সঙ্গে এই নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি হেসে বলেন, ‘মুরগিকে আর কীভাবে নেওয়া যাবে। শক্ত করে না বাঁধলে তো ছুটে পালাবে। আলতোভাবে হাতে করে ডানা ধরে নিতে গেলেও তো পা দিয়ে আঁচড় দিতে পারে। শুধু আইন দিয়ে কি সব হয়!’
রাজশাহী সুশিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক ফারুক হোসেন বলেন, ফলের ফরমালিন ধরার জন্য যেভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত করা হয়, এ ক্ষেত্রেও সে রকম করা হলে মানুষ সচেতন হতে পারে। যাঁরা জীবজন্তুর প্রতি সদয় আচরণ করতে পারেন না, তাঁরা মানুষের সঙ্গেও ভালো আচরণ করতে পারেন না। এ জন্য এই আইনটিও মানা জরুরি।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এস এম আবদুল কাদের বলেন, মানুষকে সচেতন করার জন্য এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালত করা উচিত। অচিরেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাজশাহীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত করা হবে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply